আমার ভবিষ্যৎ নরকবাস : মিথলজি ও অজনপ্রিয় ধর্মানুসারে

আমার ভবিষ্যৎ নরকবাস : মিথলজি ও অজনপ্রিয় ধর্মানুসারে
কাফি রশিদ, ২১/০১/১৩

অজ্ঞেয়বাদী-সংশয়বাদী হিশেবে প্রায়ই ভাবি স্রষ্টা যদি থেকে থাকেন তাহলে পুনর্জীবনে আমার অবস্থা ক্যামন হবে। স্রষ্টা থেকে থাকলে শুধু আমার মতোন নির্দিষ্ট কোন ধর্মহীনই না, ঘোর নাস্তিকসহ প্রায় ৪,২০০টি ধর্মের বিশ্বাসীগনও নরকে যাবে। প্রতিটি ধর্মই যেহেতু অন্যান্য ধর্মসমূহকে বাতিল করে দেয়, কাজেই শতকরা হিশেবে স্বর্গে যাবে অ্যামন মানুষের সংখ্যা ০.০০০০০০১ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হতে পারে, এর বেশি কোনভাবেই সম্ভব না। যেহেতু আমি স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান, প্রচলিত ধর্মানুসারে আমি নিশ্চিত নরকবাসী হবো। যতটুকু আশা ছিলো তার সবটুকুই অপেক্ষাকৃত অজনপ্রিয় ধর্ম নিয়ে, দ্যাখা যাক সেগুলো কী বলে!



১১৮০ সালের দিকে করা নরকের ইলাস্ট্রেশন

প্রাচীন ধর্মসমূহে নরক ছিলো নির্দিষ্ট কিছু দেব-দেবী নিয়ন্ত্রণাধীন। বিষয়টা এভাবেও বলা যায়, খারাপ মানুষদের কিছু দেব-দেবীর রাজ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়, এটাই আমাদের দৃষ্টিতে নরক। এইরকম কয়েকদজন দেব-দেবী হলেন : হেডিস, এনমা, হেল, নিরগাল ও ডেভিল।


দেবী হেল

ইংরেজি হেল (Hell) শব্দটি এসেছে নর্স মিথলজি (জার্মান দেশীয়) থেকে, যেখানে বলা হয়েছে Hell হচ্ছে Hel নামক এক দেবীর নিয়ন্ত্রাণাধীন অন্ধকার, মেঘাচ্ছন্ন, কণ্টকাকীর্ন রাজ্য। সব ধর্মেই যে নরক থাকবে অ্যামন কিন্তু না, কিছু কিছু ধর্মে নরকবাসের পরিবর্তে সম্পূর্নরূপে ধ্বংস করে দেয়া হয়, অথবা পারগাটরি বা শুদ্ধিস্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়, অথবা পারগাটরি ও নরকের মধ্যবর্তী স্থান লিম্বো-তে পাঠিয়ে দেয়া হয় যেখানে কঠিন শাস্তি নেই, আবার সুযোগসুবিধাও নেই। লিম্বো'র কথা পাওয়া যায় নিউ টেস্টামেন্টে।


প্রাচীন মিশরীয় ধর্মানুসারীদের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে আঁকা লুসিফারের শাস্তি 

প্রাচীন মিশরীয় ধর্মানুসারে মৃত্যুর পর আমাকে ৪২ জন বিচারকের সম্মুখীন হতে হবে। সেখানে তারা যদি মনে করে আমি দেবী মাত'র দ্যাখানো পথে ছিলাম, তাহলে আমি স্বর্গে চলে যাবো। আমি যেহেতু দেবী মাত-কে চিনি না, তাই আমাকে প্রথমে খারাপ আত্মাদের জ্বালাতন সহ্য করতে হবে, তারপর "if satisfy" পিউরিফিকেশন অনুযায়ী পুনর্জন্ম হতেই থাকবে।

প্রাচীন গ্রীস দেশের পুরাণ অনুসারে আমার স্থান হবে টার্টারাসে, স্বর্গ-মর্ত্য-সমুদ্রের নিচে অবস্থিত এক অন্ধকার ডানজনে। সেখানে আমাকে তত্ত্বাবধান করবে হেডিস, আমাকে শাস্তি হিশেবে হয়তো পাতালের প্রাণিদের অখাদ্য হতে হবে, অথবা তাদের সাথে মল্লযুদ্ধ করে টিকে থাকতে হবে। ব্যাপারটা আমার পছন্দ হচ্ছে না, সার্বারাস নামে হেডিসের তিন মাথা-অলা এক কুকুর আছে।


ইনি দাইয়ু'র শাস্তিদাতা 

চৈনিক মিথলজি অনুসারে মৃত্যুর পর আমার স্থান হবে "দাইয়ু" নামক স্থানে, যার সাথে নরকের চেয়ে পারগাটরি'র মিল বেশি। বৌদ্ধধর্মের নরকের কনসেপ্টের সাথে স্থানীয় কিছু ইহলৌকিক ও ঐশ্বরিক বিশ্বাস মিশিয়ে দাইয়ু কল্পনা করা হয়েছে। দুনিয়ায় যারা খারাপ কাজ করেছে, যারা চৈনিক দেব-দেবীদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেনি তাদের যায়গা হবে দাইয়ু-তে, রাজা ইয়ানলু ওয়াং'র তত্ত্বাবধানে। মৃত্যুর পর আমাকে অনুর্ধ্ব দশজন রাজা'র সম্মুখীন হতে হবে আমার কৃতকর্ম অনুযায়ী। আমি তাদের সন্তুষ্ট করতে না পেরে লাখ লাখ টুকরা হয়ে যাবো, হয়তো আমার মাথা কেটে ফেলা হবে, কোটি কোটি চাকু সাজানো গাছ বেয়ে উঠতে হবে, হয়তো আমাকে জ্বলন্ত কয়লার খনিতে নিক্ষেপ করা হবে। দাইয়ু যেহেতু শুদ্ধিস্থান, তাই আমাকে শুদ্ধ করে পৃথিবীতে পূনর্জন্ম হবে। ইয়ানলু ইয়াং ইচ্ছা করলে আমাকে আরো শাস্তি প্রদানের জন্য পশু, দরিদ্র অথবা রোগা মানুষ হিশেবে পাঠাতে পারেন।

আফ্রিকার হায়দা ও সোয়াহিলি মিথলজি অনুযায়ী মৃত্যুর পর আমাকে (আমার আত্মাকে) "জানিও" নামক পবিত্র স্থানে পৌছাতে হবে। অতি অবশ্যই আমি সেখানে পৌছাতে পারবো না, কারণ আমি সেরের ধর্মীয় রীতিগুলো জানিনা। আমি জানিও যাওয়ার পথে হারিয়ে যাবো, তবে এখানে আমার দেহকে নারকীয় কোন যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না। হয়তো জানিও'র পথ খুঁজে না পেয়ে আমি আ-আত্মাজীবন কাঁদতে থাকবো। চমৎকার।

অ্যাজটেকদের মধ্যে যারা মিক্টল্যান ধর্মে বিশ্বাস করে, তাদের মতে আমি দীর্ঘ চার বছর ছুটে বেড়াবো এক পাহাড়ি উপত্যকার মধ্য দিয়ে, যেখানে এক পাহাড়ের চূড়া ভেঙ্গে আরেক পাহাড়ের চূড়ায় বসে পরেছে, দিগন্ত বিস্তৃত এক মাঠের মধ্য দিয়ে যেখানে বাতাসে মাংশ কেটে ফেলা চাকু উড়ে বেড়ায়, আর সাঁতার কাটবো রক্তের নদীতে, হিংস্র জাগুয়ারদের সাথে টেক্কা দিয়ে। চার বছরের পথ অনন্তকাল হয়ে পরবে যদি না আমি শাদা ফুলের দেশে দেবতা মিক্টল্যানলেকুটলি ও তার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করতে না পারি।


বৌদ্ধ ধর্মানুসারীদের মতে নরকের শাস্তি 

বৌদ্ধ ধর্মানুসারে আমার কৃতকর্ম অনুসারে পাঁচস্থানে পূনর্জন্ম হতে পারে। সিদ্ধার্থদা-কে আমি ভালো পাই, তবে তিনি সম্ভবত আমাকে ভালো পান না। তাই আমার পূনর্জন্মে আমি নরকে জন্মলাভ করবো। তবে সেখানে আমাকে আজীবন থাকতে হবে না, নরক যন্ত্রণা ভোগ করে অন্য চারটি দুনিয়ার একটিতে আমার পূনর্জন্ম হবে। সেখানেও যদি আমাকে ভালো না পান তাহলে আবারও নরকে পূনর্জন্ম হবে। আমি পূর্বজন্মে হয়তো নির্বাণ লাভ করেছিলাম, যেকারণে আমার জন্ম হয়েছে পৃথিবীতে। খারাপ না ব্যাপারটা।

বেদ যদি হিন্দু ধর্মের বাকিসব ধর্মগ্রন্থ বাতিল করে দেয়, তাহলে আমার নরকে যেতে হবে না। বেদে নরকের উল্লেখ নেই। একইভাবে ইহূদীদের ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুসারেও আমাকে নরকে যেতে হবেনা, সেখানেও নরকের উল্লেখ নেই। যদিও পরবর্তীতে তালমূদে নরক-সদৃশ স্থানের কথা বলা হয়েছে, যেখানে আগুনের সাথে বরফও ছিলো। আমি যেহেতু নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বাসিন্দা তাই আমার স্থান হবে বরফশীতল নরকে। ঠান্ডায় আমার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাবে, শাস্তি টের পাবো না।


A Cold Day in Hell

বেদিক ও ওল্ড টেস্টামেন্টের মতোন নরক বলতে কিছু নেই উইকা ধর্মানুসারীদেরও। তারা বিশ্বাস করে তাদের দেবতা খুবই ভদ্র একজন দেবতা, যিনি উইকানদের সব পাপ ক্ষমা করে দিবে। চীন দেশের তাও ধর্মেও কোন নরক নেই। বলতে গ্যালে ঘোর নাস্তিকদের মতোন আমরা যারা অজ্ঞেয়বাদী তাদের কাছেও স্বর্গ-নরক বলতে কিছু নেই, থাকলেও স্বর্গ-নরক অপেক্ষা ক্ষুদ্র মানবজীবনই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ন। লালন বলেছিলেন, "ভবে মানবগুরু নিষ্ঠা যার, সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার"। কবি শেখ ফজলুল করিম বলেছেন :

কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরষ্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে।

ছবি : উইকিমিডিয়া কমন্স