গ্রীক বীর হারকিউলিসের স্ত্রী-পুত্র হত্যা ও প্রায় অসাধ্য বারোটি শ্রম সাধন

গ্রীক বীর হারকিউলিসের স্ত্রী-পুত্র হত্যা ও প্রায় অসাধ্য বারোটি শ্রম সাধন

কাফি রশিদ, ৮/১১/১২

হারকিউলিসকে বলা হয় মর্তের সবচে শক্তিশালী মানুষ। তার ছিলো অসাধারণ শক্তি, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। হারকিউলিস বিশ্বাস করতেন তিনি যেই বিশ্বাসটি ধারণ করছেন তার বিপক্ষে যেই থাকুক না ক্যানো তিনি কখনো পরাস্ত হবেন না। তার জন্ম হয়েছিলো থিবিসে। জন্মের দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার পিতা হিশেবে সেনাপতি অ্যাম্ফিত্রিয়নকে ধরা হতো, প্রকৃতপক্ষে তার পিতা ছিলেন দেবতা-রাজ জিউস, আর মাতা আল্কমিনা। সেনাপতি অ্যাম্ফিত্রিয়ন যখন এক যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, তখন তার ছদ্মবেশে জিউস আল্কমিনার সাথে মিলিত হন। আল্কমিনার ছিলো দুই সন্তান – জিউসের ঔরসে হারকিউলিস, আর অ্যাম্ফত্রিয়নের ঔরসে ইফিক্লিস। দেবতা-রাজের পুত্র হওয়াতেই কিনা কে জানে, শিশু বয়সেই হারকিউলিসের ছিলো প্রচণ্ড শক্তি। বরাবরের মতোই জিউস-পত্নী হেরা ঈর্ষাকাতর হয়ে হারকিউলিসকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন। 

একদিন আল্কমিনা দুই শিশুপুত্র হারকিউলিস ও ইফিক্লিসকে দুধ খাইয়ে দোলনায় শুইয়ে দিলেন ঘুমানোর জন্য। দোলনা দুলিয়ে গান শুনিয়ে তার ঘুম পাড়িয়ে আল্কমিনা নিজের ঘরে ফিরে গ্যালে হারকিউলিস ও ইফিক্লিসের দোলনায় দুটি বিষধর সাপ উঠে এলো। ফণা নাচিয়ে ছোবল দেয়ার ভঙ্গী করতেই ইফিক্লিস ভয়ে আর্তনাদ করে উঠলো, হারকিউলিস তা করলো না, দুই হাতে দুটি সাপের গলা দৃঢ়ভাবে চেপে ধরে রাখলো। ইফিক্লিসের চিৎকার শুনে অ্যাম্ফিত্রিয়ন ও আল্কমিনা তাদের ঘরে আসলে হারকিউলিস অ্যাম্ফিত্রিয়নের হাতে সাপ দুইটি তুলে দিল, ততক্ষণে শ্বাসরোধ হয়ে সাপ দুটির মৃত্যু হয়েছিলো। তারা বুঝতে পারলেন হারকিউলিস একদিন বড় কিছু হবে। থিবিসের অন্ধ ভবিষ্যৎবক্তা টাইরেসিয়াস আল্কমিনাকে বললেন, “আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে অনেক গ্রীক নারী সন্ধ্যাকালে ওল বুননের সময় তোমার পুত্রের ও যে তাকে গর্ভধারণ করেছিলো সেই তোমার গুণকীর্তন করবে। সে হবে সমগ্র মানবজাতির গর্ব।”

সাপ হাতে শিশু হারকিউলিস

বালক হারকিউলিসকে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে খুব সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছিলো। কারণ তখনকার গ্রীক বালকেরা যা পছন্দ করতো তা সে পছন্দ করতো না। অন্যরা সংগীত পছন্দ করলেও তিনি তা প্রচণ্ড অপছন্দ করতেন, অ্যামনকি তার সংগীত শিক্ষককে বীণা দ্বারা আঘাত করে হত্যাও করেছিলেন, যদিও ইচ্ছাকৃত ছিলো না। এই ঘটনার পর হারকিউলিস খুবই দুঃখ পেলেন, কিন্তু এইধরণের কাজকর্ম থেকে সে মোটেই বিরত ছিলেন না। এরপর তাকে যুদ্ধবিদ্যায় দীক্ষা দেয়া হলো। তরবারি-চালনা, কুস্তি ও অশ্ব-চালনা তিনি খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছিলেন। ইতিমধ্যে হারকিউলিস আঠারো বছরে পদার্পন করলেন। প্রাপ্তবয়স্ক হয়েই হারকিউলিস সিথিরিয় বনের বিশাল থেসপিয় সিংহ হত্যা করে তার শক্তির পরীক্ষা দিলেন। এরপর সিংহের চামড়া দিয়ে নিজের পোষাক বানালেন আর মাথা ব্যবহার করলেন শিরোনাস্ত্র হিশেবে। 

এরপর তিনি মিনিয়দের বিরুদ্ধে থিবিয়দের কাছ থেকে কর আদায়ের অভিযোগ এনে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। থিবিসবাসী বিজয়ী হারকিউলিসের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ থিবিসের রাজা ক্রেয়ন কন্যা রাজকুমারী মেগারা-কে তার সাথে বিয়ে দিলেন। সুখে শান্তিতে অনেক বছর কাটানো পর যখন তার হারকিউলিস ও মেগারা’র তিনটি পুত্রসন্তানের জন্ম হলো, তখন দেবী হেরা আবারো হারকিউলিসের বিরুদ্ধে লেগে গেলেন। তিনি হারকিউলিসকে উন্মাদে পরিণত করেন, উন্মাদ হারকিউলিস একদিন হত্যা করেন মেগারা ও তার তিন সন্তানকে। হত্যার পর যখন প্রকৃতস্থ হলেন তখন নিজেকে আবিষ্কার করলেন রক্তস্নাত এক কক্ষে। সৎ পিতা অ্যাম্ফিত্রিয়ন হারকিউলিসকে জানালেন তার কৃতকর্মের কথা, সাথে এও জানালেন যে হেরা তার প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে এই কাজ করিয়েছেন। তারপরও হারকিউলিস নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলেন না। তিনি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলে তার বন্ধু থিসিউস এগিয়ে এলেন আর তার কৃতকর্মের অর্ধেক দায়-দায়িত্ব নিজের ঘারে চাপিয়ে নিলেন। থিসিউস তাকে পরামর্শ দিলেন থিবিসের জন্য বড় কিছু করে দ্যাখাতে। হারকিউলিস এরপর ডেলফির মন্দিরে গিয়ে সেখানকার পুরোহিতানির সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন। পুরোহিতানি তাকে বললেন যে তার অবশ্যই পংকিলতামুক্ত হওয়া উচিৎ, আর তা হতে হবে ভয়ঙ্কর কোন প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে। পুরোহিতানি তাকে পরামর্শ দিলেন মাইসিনিতে তার চাচাতো ভাই ইউরেন্থিউসের কাছে যেতে, কারণ তিনি জানতেন ইউরেন্থিউস হারকিউলিসকে পুরোপুরিভাবে বিশোধিত করবেন। 

হারকিউলিস রাজি হয়ে ইউরেন্থিইউসের কাছে গেলে ইউরেন্থিউস প্রায়শ্চিত্তের একটা তালিকা তৈরী করলেন। তালিকাটিতে ছিলো প্রায় অসম্ভব ১২টি শ্রম, যা কোন মানুষ করতে পারবে বলে কেউ ভাবতে পারেনি। তালিকাটি তৈরি হয়েছিলো হেরা’র নির্দেশে, স্ত্রী-পুত্রদের হত্যা করিয়েও যিনি হারকিউলিসের উপর ক্রোধান্বিত ছিলেন। “হারকিউলিসের শ্রম” নামে পরিচিত এই ১২টি শ্রমের

নিমিয় সিংহ বধ

প্রথম শ্রমটি ছিলো নিমিয়ার সিংহ বধ করা, যে সিংহটিকে কোন অস্ত্রই আহত করতে পারতো না। প্রচণ্ড শক্তিশালী হারকিউলিস শ্বাসরোধ করে সিংহটিকে বধ করে ঘারে করে মাইসিনিতে নিয়ে গেলে ইউরেন্থিউস তাকে দ্বিতীয় শ্রমের কথা জানান। 

হাইড্রা বধ

দ্বিতীয় শ্রমটি ছিলো লার্না’য় গিয়ে সেখানকার এক জলাভূমিতে বসবাসরত হাইড্রা নামক এক নয় মাথা বিশিষ্ট প্রাণীকে হত্যা করা। হাইড্রা’র একটি মাথা ছিলো অমর, বাকি আটটি মাথাও ছিলো সমান বিপদজনক, হারকিউলিস যখন একটি মাথা কাটলেন তখন সেখান থেকে আর দুইটি মাথা বের হলো। একাজে হারকিউলিসকে সাহায্য করলেন তার ভাগ্নে আয়োলাস। আয়োলাস তাকে একটি জ্বলন্ত লোহার মশাল এনে দিলেন যা দিয়ে হাইড্রার মাথা কেটে ঘাড় ঝলসে দেয়া হলো য্যানো সেখান থেকে আর কোন মাথা গজাতে না পারে। সবগুলো মরণশীল মাথা কাটা হয়ে গেলে হারকিউলিস অমর মাথাটি এক বিশাল পাথরের নিচে চাপা দিয়ে রাখলেন।

তৃতীয় শ্রমটি ছিলো সেরেনিয়াসের বনের স্বর্ণের শিং যুক্ত এক পুরুষ হরিণ জীবিত ধরে আনা, যা আর্টেমিসের প্রিয় ছিলো। হরিণটিকে তিনি সহজেই হত্যা করে আনতে পারতেন, কিন্তু জীবিত ধরে আনা খুবই কষ্টকর ছিলো বিধায় তার এক বছর লেগে গ্যালো এই কাজে। 

এরিমেন্থাসে শুকর বধ

চতুর্থ শ্রমটি ছিলো এরিমেন্থাস পর্বতের গুহায় বাস করা এক বন্য শুকর বধ করে আনা। হারকিউলিস শুকরটিকে ধাওয়া করতে লাগলেন যতক্ষণ না পর্যন্ত সেটা ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পরে। এরপর তিনি শুকরটিকে বধ করে আনলেন। 

পঞ্চম শ্রমটি ছিলো রাজা অজিয়াসের আস্তাবলগুলোকে একদিনের মধ্যে পরিষ্কার করা। অজিয়াসের ছিলো হাজার হাজার গরু, আস্তাবলে সেগুলোর বিষ্ঠা কখনো পরিষ্কার করা হয়নি। হারকিউলিস দুটি নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে সেগুলোর স্রোতের প্রবাহ সেই আস্তাবলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করলেন। মুহুর্তের মধ্যে জঞ্জাল পরিষ্কার হয়ে গ্যালো। 

ষষ্ঠ শ্রমটি ছিলো স্টিমফ্যামিয়নের পাখিগুলোকে তাড়িয়ে দেয়া। অসংখ্য পাখি স্টিমফ্যালিয়নবাসীর জন্য বয়ে এনেছিলো অসহনীয় দূর্ভোগ। এগুলোকে ঝোপঝাড় থেকে তাড়াতে হারকিউলিসকে সাহায্য করলেন দেবী অ্যাথেনা। 

পোসেডোনের ষাঁড় ও হারকিউলিস

সপ্তম শ্রমটি ছিলো ক্রীট দ্বীপে গিয়ে মিনোসকে উপহার দেয়া পোসেইডোনের সুন্দর ষাঁড়টি নিয়ে আসা। হারকিউলিস ষাঁড়টিকে পোষ মানিয়ে নৌকায় করে ইউরেন্থিউসের কাছে নিয়ে এলেন।

অষ্টম শ্রমটি ছিলো থ্রেসের রাজা ডায়োমিডাসের নরখাদক ঘোড়াগুলোকে নিয়ে আসা। দেবতাদের অভিশাপে নিহত ডায়োমিডাসের ঘোড়াগুলোকে হারকিউলিস বিনা বাঁধায় ইউরেন্থিইউসের কাছে নিয়ে এলেন।

নবম শ্রমটি ছিলো আমাজনদের রাণী হিপ্পোলাইটির কোমরবন্ধনী নিয়ে আসা। হারকিউলিস হিপ্পোলাইটির কাছে গেলে তিনি জানালেন হারকিউলিসকে তার কোমরবন্ধনী দিয়ে দিবেন। কিন্তু হেরা এখানে এক অঘটনের জন্ম দিলেন। হেরা আমাজনদের ভাবতে বাধ্য করলেন যে হারকিউলিস হিপ্পোলাইটিকে অপহরণ করতে এসেছেন। আমাজনেরা তখন হারকিউলিসের জাহাজ আক্রমণ করে বসলো। হারকিউলিস তখন বিনা কারণেই হিপ্পোলাইটিকে হত্যা করে ফেললেন, এই ভেবে যে তার উপর আক্রমণের সব দায়ভার হিপ্পোলাইটিরই। এরপর আমাজনদের পরাজিত করে হিপ্পোলাইটির কোমরবন্ধনী নিয়ে এলেন। 

দশম শ্রমটি ছিলো পশ্চিমাঞ্চলীয় দ্বীপ ইরাইথিয়াতে বসবাসরত তিন মাথা বিশিষ্ট দানব গেরাইয়নের গরুগুলোকে নিয়ে আসা। সেখানে যাওয়ার পথে হারকিউলিস ভূমধ্যসাগরে স্থাপন করলেন দুটি বিশাল পাথরের স্তম্ভ, যা তখন “হারকিউলিসের স্তম্ভ” নামে পরিচিত ছিলো, বর্তমানে যা জিব্রালটার ও কিয়োটা নামে পরিচিত। সেখানে গিয়ে তিনি গরুগুলোকে খুঁজে পেয়ে ইউরেন্থিউসের কাছে নিয়ে এলেন। 

অ্যাটলাসের কাঁধ থেকে ভার নিচ্ছেন হারকিউলিস

একাদশ শ্রমটি ছিলো হেসপেরাইডিসদের কাছ থেকে স্বর্ণ আপেল নিয়ে আসা। হারকিউলিস জানতেন না এগুলো কোথায় পাওয়া যাবে। হারকিউলিস হেসপেরাইডিসদের পিতা অ্যাটলাসের কাছে গেলেন, যিনি দুই হাতে আকাশ ধরে রাখছিলেন। তিনি হারকিউলিসকে আপেলের ব্যবস্থা করে দেবেন বলে জানালেন। হারকিউলিস প্রস্তাব করলেন যতক্ষণ না পর্যন্ত খুঁজে পান ততোক্ষণ হারকিউলিস আকশের ভার বহন করবে। অ্যাটলাস যখন দেখলেন ভার বহন করার মতো কঠিন কাজ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা পথ আছে তখন তিনি রাজি হয়ে গেলেন। হারকিউলিসের কাঁধে আকাশ চাপিয়ে দিয়ে তিনি আপেল নিয়ে এলেন। এসে বললেন যে তিনি নিজেই ইউরেন্থিউয়াসের কাছে আপেল পৌছে দেবেন। হারকিউলিস অ্যাটলাসের মনের ভাব বুঝতে অ্যাটলাসকে বললেন কিছু সময়ের জন্য আকাশ ধরে রাখতে য্যানো হারকিউলিস কাঁধে নরম কাপড়ের আচ্ছাদন লাগিয়ে নিতে পারে। নির্বোধ অ্যাটলাস রাজী হলে হারকিউলিস আপেল নিয়ে দ্রুত সরে পড়লেন। 

দ্বাদশ শ্রমটি ছিলো পাতালে গিয়ে তিন মাথা বিশিষ্ট কুকুর সারবেরাসকে মর্তের আলোতে নিয়ে আসা। প্লুটো হারকিউলিসকে এই শর্তে অনুমতি দিলেন যে সারবেরাসের উপর কোন অত্যাচার করা যাবে না। শর্ত মেনে সারবেরাসকে কাঁধে করে হারকিউলিসকে ইউরেন্থিউসের কাছে নিয়ে এলেন। অবশ্য তাকে ইউরেন্থিউস আবার ফেরত পাঠালেন সারবেরাসকে ফিরিয়ে দিতে।

বারোটি শ্রম পূর্ন করে হারকিউলিস স্ত্রী-পুত্র হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করলেন। ভাবার কোন কারণ নেই যে হারকিউলিস এরপর সুখে শান্তিতে জীবনযাপন করলেন। মূলত হারকিউলিসের বিভিন্ন রোমাঞ্চকর ও কষ্টকর অভিযানের শুরুই হয়েছিলো এই বারোটি শ্রমের মাধ্যমে।