ভূত-প্রেত

ভূত শুনতেই ভূত ভূত লাগে। ভূত বলতে আসলে কিছু নাই। ভূত ছিল ভয়ের সমার্থক শব্দ। সেখান থেকে কোন জুয়োলজিস্ট ভাষাতত্ত্ববিদের ভুলে ভূত সব প্রানী থেকে আলাদা ‘কিছু একটা’ হয়ে গ্যাছে। এরপর থেকে অন্যান্য প্রাণীর মতোন ভূতেরও শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে। এইটা আমার ধারনা। ভূতের কোন বিশেষ সংজ্ঞা না থাকলেও শোনা যায় অতৃপ্ত মানুষেরা মরে যাওয়ার পর তারা স্বর্গ-নরকে না গিয়ে ভূত হয়ে যান। মুসলিম ধর্মে ভূতের অস্তিত্ব না থাকলেও হিন্দু ধর্মে ভূতের অস্তিত্ব আছে। অনেক হিন্দু আর গ্রীক দেব-দেবীকে ভূতের মতোন মনে হয়। মুসলমানেরা বদ জ্বীন বা পরীকে ভূত বলতে পারে। বদ জ্বীন যদি শয়তান হয় তবে ভূত স্বীকার করতে মুসলমানদের ধর্মত ঝামেলা নাই। তবে ব্ল্যাকআর্টের চর্চা করতে চাইলে অবশ্যই ঝামেলা আছে। ব্ল্যাকআর্টে শয়তানের উপাসনা করা হয়। ব্ল্যাকআর্টের উপাসনাকারীরা মনে করেন শয়তান খোদার'চে শক্তিশালী, যেহেতু ভালো কাজের থেকে খারাপ কাজ করা সহজ। বাংলাদেশের ভন্ডবাবা বা ভন্ডপীরদের চ্যালারা য্যামন নেচেগেয়ে ‘বাবাদের’ কীর্তন গায়, ত্যামন করে ব্ল্যাকআর্টের উপাসনাকারীরাও নেচেগেয়ে শয়তানের পূজা করেন। মাঝে মাঝে লুসিফার, অর্থাৎ শয়তানের উদ্দেশ্যে মানুষ বলি দেয়া হয়। ব্ল্যাকআর্টের আরেকটা জেনার হচ্ছে ভুডু। ভুডু আসলে একটা ধর্ম। দক্ষিন আমেরিকার কয়েকটা গোত্রের ধর্ম হচ্ছে ভুডু। ভুডু ধর্মে বাংলাদেশের ফকির-দরবেশদের মতোন ঝার-ফুক ও ‘বান’ মারার সিস্টেম আছে। প্রথমে একটা পুতুল যোগাড় করতে হবে। যাকে বান মারা হবে তার একটা চুল লাগবে। এরপর চুলটা ঐ পুতুলের গলায় পেঁচিয়ে মন্ত্র পড়ে পুতুলের শরীরে সুঁই ঢুকাতে হবে। যাকে বান মারা হচ্ছে তার শরীরেও পুতুলের মতোন সুঁই ঢুকবে। একেএকে পুতুলের হাত পা ছিঁড়ে ঐ মানুষটাকে মেরে ফেলা হবে। পুতুলটাকে বলে ভুডু ডল। ভুডু ধর্মে বিয়ে’র সিস্টেম খুবই অদ্ভুত। নতুন জামাই-বউ কে ছোট ছোট পাথর ছুঁড়ে আশীর্বাদ জানানো হয়। হ্যালোউইন হচ্ছে ভূতদের খুশি রাখার উৎসব। এইটা খৃস্ট ধর্মের উৎসব। নভেম্বরের এক তারিখে ভূতদের মতোন সাজুগুজু করে বাইরে ঘুরাঘুরি করতে হয়, য্যানো ভূতেরা তাদেরকে 'নিজেদের লোক' মনে করে। হ্যালোউইনে বাড়িঘর ভূত পুতুল দিয়ে সাজাতে হয়। কুমড়া দিয়ে বানানো মানুষের মাথার খুলি কমন ভূত। আমার চেনা কিছু ভূত :

টাওর : নারায়ণগঞ্জের আঞ্চলিক ভূত। হাসপাতালে জন্ম নেয়া বাচ্চা মরে গ্যালে অথবা মৃত বাচ্চা জন্ম হলে অথবা ছোট বাচ্চারা হাসপাতালে এসে অসুখে ভুগে মরে গ্যালে টাওর হয়ে যায়। টাওরদের ভিজ্যুয়ালাইজ করা হয় এভাবে- মরে যাওয়ার আগে এদের মাথায় চুল থাকুক বা না থাকুক, এরা ন্যাড়া মাথার নেংটুপুটু ভূত। এদের আনাগোনা সাধারণত হাসপাতালের পেছনের অংশে এবং সময়সূচি সূর্যাস্তের পর থেকে সূর্যোদয়ের আগপর্যন্ত। এরা বিকট হেসে অথবা ভয়ঙ্কর চেহারা দেখিয়ে মানুষদের ভয় দ্যাখায় না, আসলে এদের উদ্দেশ্য ভয় দ্যাখানো কিনা তাতে আমার সন্দেহ আছে। যারা স্বচক্ষে টাওর দেখেছেন বলে দাবী করেন, তাদের ভাষ্যমতে টাওরেরা সুন্দর সুন্দর ছোট ছোট দাঁত (জন্মের পরপর মৃত অথবা মৃতজন্মা শিশু টাওরেরাও!) বের করে খিলখিল করে হাসে। এই হাসি দেখেই নাকি মানুষের কলজে শুকিয়ে যায়। তবে টাওর কিউট ভূত। 

মামদো ভূত : মামদো হচ্ছে হিন্দু পুরাণের মুসলমান ভূত। মুসলমান অতৃপ্ত আত্মাকে মামদো ভূত বলে। এই প্রজাতির ভূত কারো কোন ক্ষতি করে না। হিন্দু বাচ্চাকাচ্চাদের ভয় দ্যাখাতে এই ভূতের গল্প বলা হয়।

পেঁচা-পেঁচি : এরা ভূত কাপল। পেঁচা-পেঁচি ভূত একসাথে ভয় দ্যাখায়। এরা সন্ধ্যার পর নাকিঁ সুরে বিলাপ করে।

আলেয়া : আলেয়া ভূত নাকি 
ভূতের লন্ঠন এইটা নিয়ে আমি কনফিউজড। আলেয়াকে ভূত বিশেষজ্ঞরা ভূত বললেও আমার মনে হয় আলেয়া আসলে ভূতের লন্ঠন। ভোর হওয়ার আগে জেলে-মাঝিরা দূরে কোথাও মানুষ অবয়বের আলো দেখতে পান, তখন তারা যতো সামনে আগান, আলো ততো দূরে পিছিয়ে যায়। ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত এইরকম চলতে থাকে। এরইমধ্যে কোন একসময় আলেয়া জেলে-মাঝিদের ডুবিয়ে মারে। ‘আলেয়া’ হয়তো সাহিত্যিক ভূত, এজন্য অনেক লেখক তার বইয়ের অথবা বইয়ের নায়িকা’র নাম দ্যান আলেয়া।

দৈত্য : দৈত্য মেইনলি হিন্দু ভূত। দৈত্য’র ধারনা এসেছে হিন্দু দেবতা রাবণ থেকে। রাবণের মাথা এগারোটা হলেও দৈত্যের মাথা সাধারনত একটাই হয়। দৈত্যের খাবার আস্ত মানুষ আর গরু। অন্য কোন খাবারের কথা শোনা যায়না।

পেত্নী : বিবাহিত ও অতৃপ্ত মহিলারা মরে গেলে পেত্নী হন। পেত্নী সবচে ডেঞ্জারাস ভূত। মানুষের ক্ষতি করে অ্যামন ভূতেদের নেত্রী হচ্ছে পেত্নী। পেত্নী সম্পর্কে একেকজন একেরকম কথা বললেও মোটামুটি সবাই নিশ্চিত পেত্নীদের দাত মূলো’র মতোন, চুল জটানো- প্রায় দশ হাত লম্বা, চোখ লাল (কেউ কেউ বলে চোখের বদলে আগুন দ্যাখা যায়), মাথায় বোঝা নিয়ে ঘুরে। আর পশ্চিমাদের থেকে শোনা যায় পেত্নীরা একটা ঝাড়ু নিয়ে চলাফেরা করে। এই ঝাড়ু’র উপর বসে পেত্নীরা উড়তে পারে। হ্যারি পটারের ব্রুমস্টিক এখান থেকেই এসেছে। পেত্নিদের পেততুনি, ফেত্নি নামেও ডাকা হয়।

বামন ভূত : বামন খুব রেয়ার ভূত। এদের কথা পশ্চিম ছাড়া প্রায় শোনাই যায় না। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এরা বামন সাইজের। বামন ভূত সম্ভবত ‘দুই’ সংখ্যা পছন্দ করে, কেননা তারা লম্বায় দুই ফুট হয়, একসাথে দুইজন করে ভয় দ্যাখাতে আসে, পরপর দুইদিন এদের দ্যাখা যায়। বামন ভূতের চোখ টকটকে লাল, কান চোখা চোখা, দাঁত সোনার হয়। এরা সাজুগুজু করতে পছন্দ করে। বামন ভূত পুরানো আমলের আলখাল্লা পরে আসে, এক কানে দুল থাকে। দুল ছাড়া তাদের সাজানোর যায়গা হচ্ছে দাঁত। দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো হয়। এরা সোনার বেল্টও পরে। বামন ভূত খনি শ্রমিকদের অতৃপ্ত আত্মা। খনি থেকে পাওয়া ধন সম্পদ ভোগ করতে না পেরে তারা ভূত হয়ে যায়।

কাঞ্চিচাটা : এরা দরজার আড়ালে থাকা ভূত। ধুপ করে অপরিচিত কেউ ঘরে ঢুকলে কাঞ্চিচাটা তাদের মেরে ফেলে। বাসার দারোয়ানদের ভূত হচ্ছে কাঞ্চিচাটা। এরা সবসময় দরজার পিছনে বসে ঝিমায়। যেই বাসায় তারা জীবিত অবস্থায় চাকরী করতো, সেই বাসার কারো অনিষ্ট এরা করে না। দীর্ঘদিন চাকরী না করলে এদের ভূত বাসায় আসে না, বাড়ির মোড়ে ঘোরাফেরা করে। অন্য কারও রুমে ঢুকার আগে প্রয়োজনীয় দোয়া-দরুদ পড়ে আস্তে আস্তে ঢুকাই শ্রেয়। এদের আরেকনাম চিপা ভূত। চিপা ভূত আমার দেয়া। 'কাঞ্চিচাটা' শুনতে বিশ্রী লাগে।

বুড়িমা ভূত : এরা মোস্ট কমন ভূত। রাতের বেলা বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এদের দ্যাখা পাওয়া যায়। এরা নাঁকি সুরে বিলাপ করতে থাকে। উৎসাহী কেউ তার সামনে গিয়ে কারন জিজ্ঞেস করলে তার ঘার মটকে পরপারে পাঠানোর ব্যাবস্থা করে দেন বুড়িমা। আমার আব্বু আর ছোট মামা বুড়িমা’র কবলে পরেছিলেন। মামা বয়সে কিছুটা ছোট হওয়ায় তার বুদ্ধি কিছুটা বেশি ছিল, যার কারনে দু'জনই বেঁচে যান।

কন্ধকাটা ভূত : নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এদের মাথা নাই। মাথা নাই মানে চোখও নাই, অ্যামন না। এদের বুকের উপর একটামাত্র চোখ। কন্ধকাটা ভূত দেখেছে অ্যামন দাবী করা সবাই বলে কন্ধকাটা ভূতের হাতে একটা কাটা মাথা দ্যাখা যায়। সেটা কন্ধকাটার নিজের মাথাও হতে পারে অথবা যাদের মেরে ফেলে তাদের কারো মাথাও হতে পারে। আমার ধারনা ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যু হওয়া মানুষ কন্ধকাটা ভূত হয়।

বাঁশঝাড়ের ভূত : এরাও গ্রামের ভূত। গ্রামে প্রায় সব রাস্তারই একটা অংশ থাকে বাঁশঝাড়ের মধ্য দিয়ে। রাত বারোটার পর কেউ রাস্তায় বের হলে ঐ অংশের বাঁশ মাটিতে শুয়ে পড়ে, তখন সে পার হওয়ার জন্য বাঁশে পা দিলেই সব খতম! ধনুকের মতোন তাকে আকাশে উড়িয়ে পাশের কর্দমাক্ত ধান ক্ষেতে নিয়ে ফেলা হবে।

লম্বা পায়ের নাম না দেয়া ভূত : সেই একটা ভূত আছে যাদের কোন নাম দেয়া হয়নি। এরা মোস্ট মোস্ট কমন ভূত। অ্যাত্তো কমন হওয়ার পরও ক্যানো তাদের নামকরন করা হয়নি সেটা এক বিরাট রহস্যের ব্যাপার। সম্ভবত এরা নামচোরা ভূত অথব খুঁতখুঁতে স্বভাবের ভূত। কোন নামই তাদের পছন্দ না হওয়ায় নাম প্রদানকারীকে সম্ভবত এরা মেড়ে ফেলে। এই কারনে এদেরকে দেয়া কোন নামই শোনা যায়না। এদের পা বিশাল, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম পর্যন্ত লম্বা হয়। এরা সাধারনত পাশাপাশি গ্রামের দুই তালগাছের উপর পা রেখে দাড়িয়ে থাকে। কেউ এদের সম্পূর্ন চেহারা দেখেনি, আবছা একটা অবয়বের কথা শোনা যায়। দুই পায়ের নিচ দিয়ে কেউ গেলে তাকে হয় পিষে মেরে ফেলা হয়, অথবা হাত দিয়ে তুলে নিয়ে কচকচ করে চিবিয়ে খাওয়া হয়। ইদানিং কিছু ভূতের গল্প লেখক বলেন পেত্নীর থেকে নেওয়া সস মিশিয়েও তারা মানুষ ধরে খায়। তবে লেখককে যেহেতু কখনো খায়নি, তাই বলা যায় সস ছাড়াই খাওয়া হয়। আমি ইচ্ছা করলে এদের একটা নাম দেয়া যায়। লম্বু ভূত অথবা বগা ভূত অথবা বাঁশ-পেয়ে ভূত।

[ + ] আরও হাবিজাবি

ভূতের শ্রেণীবিভাগ কোন ভৌতিস্টের করা না, ‘ভূত’র জন্ম ও শ্রেণীবিভাগ, প্রেতের সংজ্ঞা আমার নিজের বানানো। কারো বিশ্বাস অবিশ্বাসে আমার কিছু যায় আসে না। 


নভেম্বর, ২০১০
নারায়ণগঞ্জ

(সর্বশেষ সম্পাদনা : মার্চ ২৯, ২০১৫)