কাঞ্চনমালা'র উপাখ্যান

কাঞ্চনমালা'র উপাখ্যান
কাফি রশিদ, ১৯/১০/১৩

কোমরে রুপোর বিছা, পায়ে সোনার নুপুর আর শরীরে ঝলমলে পোষাক জড়িয়ে রাজসভায় নাচছিলেন কাঞ্চনমালা, রুপে-গুণে-নাচে-গানে অন্য সব অপ্সরা তার ধারে কাছেও নেই। বাদ্যকরের বাজনার তালে তালে নাচতে নাচতে এলোমেলো পায়ের আঘাতে হঠাৎ রাজসভায় নাচের অনুসঙ্গ মাটির সরা ভেঙ্গে গেল। পালঙ্ক থেকে উঠে বসলেন রাজা, সর্বাপেক্ষা রুপবতী-গুণবতী হলে কী হয়, শাপ থেকে বাদ গেলেন না কাঞ্চনমালাও। প্রথম শাপে কাঞ্চনমালার বেণীর বন্ধন খসে পরলো, এরপর একে একে যতো সাজসজ্জা। রাজা শাপলেন, মানুষ হয়ে জন্ম হবে কাঞ্চনমালার। পৃথিবীতে মানবী হয়ে বিশ বছর কাটালে শাপ শেষ হবে, তবেই কাঞ্চনমালার ফের স্থান হবে অপ্সরালয়ে।



নদী-সাগর পেরিয়ে চমৎকার চমৎকার চৌদ্দটি ডিঙ্গি নৌকো সাজিয়ে বানিজ্য করে বাড়ি ফেরেন সাধু সওদাগর। বাড়িটিও তার অপূর্ব, সোনালী রঙ দেখে মনে হয় তরল সোনা দেয়াল থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। কিন্তু মনে শান্তি নেই নিঃসন্তান সওদাগরের। থাকবেই বা কী করে, যে নদীতে জল নেই সে নদীর আবার নাম কীসের? ফুলে যদি মধু-ই না থাকে তাহলে ভ্রমর আসবে কেন? মন খারাপ করে বাইরে বেরোন সওদাগর, দৈবক্রমে এক সন্ন্যাসীর সাথে তার দেখা হয়। বৃত্তান্ত শুনে সন্ন্যাসী সাধু সওদাগরকে একটি ফল দেন, বলেন শনিবার কি মঙ্গলবার রাণী বৌ যেন সেই ফল খায়। তবেই পরম আরাধ্য লাভ হবে। চন্দ্রসম কন্যা সওদাগরের ঘর আলোকিত করবেই, তার গুণে সওদাগরের যতো দূর্গতিও কেটে যাবে। 

কিন্তু শর্ত জুড়ে দেন সন্ন্যাসী, কন্যার বয়স নয় বছর পূর্ণ হলে বিয়ে দিতে হবে। তা না হলে সওদাগরের চৌদ্দটি নৌকোই সাগরে ডুবে যাবে, সোনা-রঙা-বাড়ি পুড়ে ছাই হবে, ধনরত্নে শনির আছর হবে। শর্ত মেনে বাড়ি ফিরলেন সাধু সওদাগর, দিন দেখে রাণী বৌকে সন্ন্যাসীর দেয়া ফল খাওয়ালেন। তিন মাস পর রাণী গর্ভবতী হলেন। একসময় চন্দ্রমুখী কন্যার জন্ম দিলেন, সমস্ত এলাকা যেন উজ্জ্বল হয়ে গেল। কিছুদিন পর রাণী বৌ মরে গেলেন। 

নয় বছর তখনো হয়েছে কি হয় নি, মানবী কাঞ্চনমালা রুপে-গুণে অপ্সরা কাঞ্চনমালাকেও ছাড়িয়ে যায়। নরোম সোনায় বানানো দেহের দীঘল কেশের ভার সইতে কষ্ট হয়, দুই চোখে যেন আকাশের তারা নেমে এসেছে। ঠোঁট দেখে মনে হয় যেন সিঁদুরে রাঙা। নয় বছর সম্পূর্ণ হতে আর মাত্র কয়েকঘন্টা বাকি, সাধু সওদাগর দিশা পান না, একদিকে অল্পবয়স্কা কাঞ্চনমালা আরেকদিকে নৌকো-বাড়ি-ধনরত্ন। সিদ্ধান্ত নেন পরবর্তি কয়েক ঘন্টায় যার মুখ প্রথমে দেখবেন তার সাথেই বিয়ে হবে কাঞ্চনমালার। 

এমন সময় এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মন তার ছয়মাস বয়সী শিশুপুত্রকে নিয়ে সাধু সওদাগরের বাড়িতে আসেন। শিশুপুত্রের জ্বলন্ত শিখায় ন্যায় উজ্জ্বল দেহ আর ধাঁরালো ছুরির মতোন চোখ দেখে মনেই হয়না শিশুটি জন্মান্ধ। পুত্রসন্তান জন্ম দিয়েই ব্রাহ্মণের স্ত্রী মারা গেছেন, উপায় না পেয়ে তাই সাধু সওদাগরের কাছে এসেছিলেন ব্রাহ্মণটি। কিছুক্ষণ পূর্বের সিদ্ধান্তের কথা ভেবে দু'চোখ বেয়ে জল ঝরে সওদাগরের, তা দেখে কাঞ্চনমালা ভাবে সে বুঝি কোন অন্যায় করেছে। সওদাগর সব খুলে বলেন কাঞ্চনমালাকে।

নয় বছরেও যোগ্য বর না পেয়ে ছয় মাস বয়সী অন্ধ শিশুপুত্রে গৌরীদান করলেন সাধু সওদাগর। কাঞ্চনমালা কাউকে দোষারোপ করল না, রাত হলে শিশু স্বামীকে কোলে করে বনবাসে বেরিয়ে পরল। ভরাই নগরের ঘন জঙ্গলে দিনের বেলায়ও রাত বলে ভ্রম হয়, আর এ তো সত্যিই রাত। খুঁজে পেতে কাঞ্চনমালা এক দাড়াক গাছের সামনে গিয়ে গাছের কাছে আশ্রয় চাইল। সত্যযুগের গাছ বলে কথা, টোকা দেয়া মাত্র গাছ চিরে এক সন্ন্যাসী বেরিয়ে এলেন। তিনি কাঞ্চনমালা ও তার শিশু স্বামীকে গাছের কোটরে আশ্রয় দিয়ে বললেন পরদিন সকালে বৃত্তান্ত শুনে একটা ব্যবস্থা নেয়া যাবে। 

পরদিন সকালে ঘটনা শুনে সন্ন্যাসী কাঞ্চনমালাকে একটা ফল দিয়ে বললেন এই মন্ত্র পড়া ফল তার শিশু স্বামীকে খাওয়ালে সে চোখে তো দেখতে পাবেই, ছয় মাসের বাড়ও একদিনে বাড়বে। তারপর পরামর্শ দিলেন কাঠুরিয়াদের সাথে বনের শেষপ্রান্তে চলে যেতে। সেখানে গিয়ে কাঞ্চনমালা এক কাঠুরিয়া দম্পতির কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলো। সেই দম্পতির কোন সন্তান নেই, কাজেই বেশ খুশি মনেই তারা কাঞ্চনমালা ও তার শিশু স্বামীকে গ্রহণ করলেন। কাঞ্চনমালা সারাদিন কাঠুরিয়া দম্পতির সাথে কাঠ কাটে, রান্নাবান্নায় সাহায্য করে। কাঞ্চনমালা যে পথ ধরে যায় সে পথ জুড়ে যেন সৌন্দর্য বিলিয়ে যায়। ক্রমেই তার প্রশংসা চারিদিকে ছড়িয়ে পরলো। 

ইতোমধ্যে চার বছর কেটে গেছে, কাঠুরিয়া দম্পতির ধনসম্পদের দিক দিয়ে বেশ ফেঁপে উঠেছে। তারা ভাবে কাঞ্চনমালা স্বয়ং দেবী, আর তার কোলে যে শিশু ছিল, যার নাম ফুলকুমার আর যে কিনা প্রতিদিন ছয়মাসের বাড় বেড়ে উঠছিল, সে দেবতার অংশ। একদিন বনে এক রাজা এলেন পাখি শিকার করতে। ফুলকুমারকে দেখে রাজার সন্দেহ হলো এ কোন কাঠুরিয়ার সন্তান নয়। কপালে রাজটীকা দেখে রাজা সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে। 

এদিকে কাঞ্চনমালার কান্নায় তার ঘর ভেসে যায়, বন ভেসে যায় বনের পশুপাখির কান্নায়। ফুলকুমারের খোঁজে কাঠুরিয়ার সঙ্গে বেরোয় কাঞ্চনমালা। ছয় বছর ধরে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে মানুষখেকোর দেশ হয়ে তারা জৈন্তিয়া পাহাড়, পাহাড় পেরিয়ে গারো-কুকিদের দেশ, তারও পরে সুরমা পেরিয়ে সুমাই নগরে পৌঁছায়। সেখানে তখন ঢাক-ঢোল-কাশীর শব্দে উৎসবমুখর পরিবেশ- রাজকন্যার জন্য দাসী চাই। ক্লান্ত-শ্রান্ত কাঞ্চনমালা সিদ্ধান্ত নেয় রাকজন্যার দাসী হয়ে সুমাই নগরে থেকে যাওয়ার। কাঠুরিয়ার কাছ থেকে বিদায় নেয় কাঞ্চনমালা, কাঠুরিয়া নেয় রাজার লস্করদের থেকে কয়েক লক্ষ মুদ্রা। 


চলবে