পৌরাণিক চরিত্র : ঘোড়া-মানব কিন্নর ও হংস-মানবী কিন্নরী

পৌরাণিক চরিত্র : ঘোড়া-মানব কিন্নর ও হংস-মানবী কিন্নরী
কাফি রশিদ, ২০/০১/১৩


কিন্নর

"আমরা জন্ম-জন্মান্তরে মানবের ভালোবাসা পেয়ে যাবো, ভালোবেসে যাবো... আমরাই নর, আমরাই নারী, তবে কখনো কারো পিতা অথবা মাতা হতে পারবো না... আমাদের জীবন অনন্ত সুখের জীবন।" - মহাভারতের আদি পর্বে এভাবেই নিজেদের পরিচয় দিয়েছে কিন্নরগন। তারা মানুষ, দেবতা অথবা পশু কোনটাই ছিলো না। গ্রীস দেশের সেন্টারদের সাথে তাদের মিল পাওয়া যায়, অর্ধেক ঘোড়া অর্ধেক মানব। কোথাও বলা হয় তাদের মাথা ছিলো ঘোড়ার, কোথাও বলা হয় তাদের দেহের নিম্নাংশ ছিলো ঘোড়ার মতোন। আকৃতি য্যামন কুৎসিতই হোক না ক্যানো, তারা ছিলো দেব-দেবীদের সুকণ্ঠী গায়ক। তারা প্রজননক্ষম না হলেও কোন এক প্রকারে তাদের বংশবিস্তার হতো। কোন কোন পুরাণে তাদের গন্ধর্বদের উপজাত বলা হয়েছে।


ইলাদেবী ও বুধের বিয়ে

প্রাচীন ভারতের পুরাণ অনুসারে ধীমান পুলস্ত্য'র সন্তান কিন্নরদের বাস ছিলো হিমালয়ের গভীর কোন এক অঞ্চলে, দেবতা, অসুর, রাক্ষস, পিশাচ, গন্ধর্বদের সাথে। প্রথমদিকে কিন্নরগন ছিলো ইল নামের এক হতভাগ্য দেবতার সেনা, যিনি চন্দ্রবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। একদিন পার্বতীর নিষিদ্ধ কুঞ্জবনে ঢুকে পরলে অভিশাপে তার লিঙ্গান্তর ঘটে, দেবতা ইল থেকে তিনি হয়ে পরেন ইলাদেবী। এরপর দেবতা বুধ'র সাথে ইলাদেবীর বিয়ে হলে বুধ কিন্নরদের সেনাকুঞ্জ থেকে মুক্তি দিয়ে গায়কে রূপান্তর করেন।


কিন্নরী, থাইল্যান্ডের একটি ভাস্কর্য

মহাভারত ছাড়াও কিন্নরদের দ্যাখা পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশের পুরাণে, বার্মিজ, থাই, কম্বোডিয়ান, শ্রীলঙ্কান সহ দক্ষিন-পূর্ব ভারতের পুরাণেও। দক্ষিন-পূর্ব ভারতের পুরাণসমূহে কিন্নরদের স্ত্রী-লিঙ্গের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, কিন্নরি। কিন্নরীদের শরীরের ঊর্ধাংশ ছিলো মানবাকৃতির, নিম্নাংশ হাঁস আকৃতির। থাই পুরাণেও কিন্নরীদের এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে, থাই পুরাণ অনুসারে তাদের হাঁসের মতোন ডানা ছিলো মর্ত্যলোক থেকে স্বর্গলোকে উড়ে যাওয়ার জন্য। তারা নেচে-গেয়ে-কাব্য রচনা করে দেবতাদের মনোরঞ্জন করতো। হিন্দু ধর্মীয় পুরাণ ছাড়াও কিন্নর-কিন্নরীদের দ্যাখা মেলে বৌদ্ধধর্মীয় পুরাণেও। কিন্নরদের কথা পাওয়া যায় মহাযান পদ্ম সূত্রে। বার্মিজ পৌরাণিক উপকথা অনুসারে মহামতি বুদ্ধ পূর্বজন্মে যে ১৩৬টি প্রাণির বেশে ছিলেন, তার মধ্যে চারটি রূপ ছিলো কিন্নর। আর বুদ্ধের পায়ের ছাপে যে ১০৮টি প্রাণির চিহ্ন ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে একটি হলো কিন্নরী।

কিন্নর-কিন্নরীদের কৃতকর্ম অনুসারে কারো কণ্ঠ ভালো হলে তাকে বলা হয় কিন্নরকণ্ঠ, আর ক্ষমা-অনুগ্রহ-সৌন্দর্যের প্রতীক হিশেবে ধরা হয় কিন্নরীদের। প্রাচীন ভারতের এক ধরণের বীণা'র নামকরণও করা হয়েছিলো কিন্নর-বীণা নামে।

ছবি : উইকিমিডিয়া কমন্স