আমাদের গ্রামের কয়েকজন সাধারণ মানুষ ও একজন মইন্যা রাজাকারের কথা। প্রথম পর্বঃ আবু বকর মিয়া।

আমাদের গ্রামের কয়েকজন সাধারণ মানুষ ও একজন মইন্যা রাজাকারের কথা। প্রথম পর্ব : আবু বকর মিয়া
কাফি রশিদ, ১৬/১১/১২

বছর ছয়েক আগে জানুয়ারি'র এক কনকনে শীতের রাতে দ্বীপের মতোন চর-বহুল পদ্মা পাড়ি দিয়ে ফরিদপুর থেকে ঢাকার দোহারে আসেন ৫৫-৫৬ বছর বয়সের আবু বকর মিয়া। উদ্দেশ্য স্থানীয় কারো ক্ষেতে "পইরাত দিয়া", অর্থাৎ কামলা খেটে জীবিকা নির্বাহ করবেন। কারো সাথে পরিচয় নেই তার, তবে পাশের বাড়ির রমিজ আলী বহুদিন এখানকার এক গৃহস্থ কলিম উদ্দীনের পইরাত খেটেছেন। সেই সূত্রে দোহারে আসা, রমিজের উত্তরসূরি হিশেবে। পথে, শীতকালে শুকিয়ে যাওয়া পদ্মার এক চরে স্টীমার আটকে যাওয়ায় আরো কয়েকজন পইরাতের সাথে কথা হয় আবু বকরের। তারাও রমিজ আলীর মতোন পুরাতন পইরাত। বিকেলে রউনা দিয়ে রাতে দোহারে পৌছে কলিমুদ্দি'র খোঁজ করলে একজন পৌছে দিলো তাকে। পরিচয় দিতেই চিনতে পারলেন কলিমুদ্দি, রাতে খেয়ে তার জায়গা হলো বারবাড়ি'র এক দো-চালা ঘরে।

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে কলিমুদ্দি'র বাড়িঘরের অবস্থা দেখেন বকর মিয়া, বেশ অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ কলিমুদ্দি। গোয়ালে বড়ো বড়ো কয়েকটি অস্ট্রেলিয়ান গাভী, একটি ষাঁড়, আর কয়েকটি হৃষ্টপুষ্ট বাঁছুড়। এককালে বকর মিয়াদেরও এইসব ছিলো, সেসব "গন্ডগোলের" আগের কথা। সেদিন ঘুরেফিরেই কাটলো তার, পরদিন থেকে ক্ষেতে নেমে গেলেন। মটরশুটির মৌসুম চলছিলো, ত্যামন কাজ নেই। আস্তে আস্তে নিজের কাজকর্ম বুঝে নিয়ে বেশ ভালোই কাজ দেখালেন তিনি। "গরু ঝাপাইনা", "গাই দুয়াইনা" থেকে শুরু করে বাড়ীর সীমানা নির্ধারণী বাশের "বানা বান্ধা" পর্যন্ত তার হাতেই হতো। ইতোমধ্যে আরো একজন পইরাত এসেছে কলিমুদ্দির ক্ষেত-খামার দ্যাখাশুনা করতে।

প্রচন্ড রোদে, কনকনে শীতের মধ্যে তাকে ক্ষেতে কাজ করতে হয়। মাঝেমাঝে ফসলী ক্ষেত পাহারা দিতে ক্ষেতেই মাচান বানিয়ে থাকতে হয় রাতে। খারাপ লাগে না ত্যামন, ছোটবেলায় বাবার সাথে অনেক রাত কাটিয়েছেন মাচানে। অবশ্য তখন থাকতেন আনন্দের জন্য, এখন জীবিকার তাগিদে। সহ-পইরাতকে নিয়ে ক্ষেতের শুকনো লতাপাতা, শিকড় জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ আগুন পুহিয়ে ঘুমিয়ে পরেন। মাঝে মধ্যেই বাড়ির কথা মনে পরে যায়। বাড়িতে তার স্ত্রী, দুই ছেলে আর এক মেয়ে আছে। আর আছেন বৃদ্ধ মা। গত ছয় বছরে তিন বার ফরিদপুরে গিয়েছিলেন বকর মিয়া। দোহারে বিরাট মেলা হয়, "ফকির বাড়ির ম্যালা"। প্রতিবার ম্যালা'র সময়ই বাড়িতে যান তিনি, এইসময়টাতে তার কাজ থাকেনা। যাওয়ার আগে ম্যালা থেকে পুতুল, মাটির হাড়ি, জামা কাপড় কিনে নিয়ে যান। এমনিতে ছয় মাস অন্তর ফরিদপুরগামী পইরাত মারফত কিছু টাকা পাঠান বাড়িতে। দুই ছেলে বাড়িতে লাগানো সব্জি হাটে বিক্রি করে কিছু টাকা আয় করে। এভাবেই তাদের দিন চলে যায়।

আমার সাথে বকর মিয়া'র দ্যাখা কিছুদিন আগে, মিনা কাজীর দোকানে, মিনা কাজীর সম্পর্কে পরে বলবো। এমনিতে মাঝে মাঝে ক্ষেত থেকে উঠে আসা রাস্তায় দ্যাখা হতো। সেদিন দোকানে কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধ চলে আসে। তার দীর্ঘশ্বাস ফেলা দেখে কিছুটা আচ করতে পারি। জিজ্ঞেস করতেই বলে ফেললেন অনেকটুকু কথা।

তার বাবারা ছিলেন চার ভাই। বিরাট এক যৌথ পরিবারে মা, ভাই, বোন, নিজেদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে থাকতেন। ঠিক কলিমুদ্দির মতোন বিশাল বাড়ি ছিলো তাদের, গোয়ালে কয়েকটি গরু, ধানী জমি। আর ছিলো পাটের ব্যবসা, মৌসুমি ফসলের ব্যবসা। বাড়ির বৌ-ঝিদের একমুহুর্ত ফুরসত ফেলার উপায় নেই, এই পাট আসছে তো এই ধান আসছে, এরপরেই মুগ, মশুর, কলাই'র ডাল চলে আসছে বস্তা বোঝাই। একাত্তর অন্যদের জন্যে সৌভাগ্য নিয়ে এলেও তাদের জন্য নিয়ে আসে চরম দুর্ভোগ, প্রচন্ড দুর্ভাগ্য।

এপ্রিল-মে মাসের দিকে মিলিটারিরা জ্বালিয়ে দেয় তাদের বসতবাড়ি, গোয়াল, উত্তরের ফসল রাখার ঘরটিও। যাবার আগে ধরে নিয়ে যায় তার বড় চাচার স্ত্রী ও ষোল বছরের কিশোরী মেয়েটিকে। সম্ভবত বড় চাচার কষ্ট দীর্ঘ করার জন্যেই তিন ভাইকে গুলি করে তাকে বাঁচিয়ে রেখে যায়। শোকে প্রায় পাগল হয়ে স্ত্রী-কন্যাকে খুঁজে বেড়িয়েও তাদের না পেয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার এক সপ্তাহ পরে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন তিনি। বকর মিয়া'র দাদী বৌ-মা ও নাতনীকে হারিয়ে সবসময় আতংকে থাকতেন। অন্যান্য ছেলে-বৌ ও নাতি-নাতনীরা পাশের গ্রামে গিয়ে লুকালেও তিনি বাড়িতেই ছিলেন, একদিন দরজায় কার য্যানো শব্দ পেয়ে ভাবেন মিলিটারিরা আবারও এসেছে। আতঙ্কে পালাতে গিয়ে উঠানে কিসের সাথে য্যানো পা বেঁধে সেখানেই মারা যান তিনি। কিছুদিন পর বকর মিয়ারা বাড়িতে ফিরলে উঠানে আবিষ্কার করেন দাদী’র পচাগলা লাশ।

ঘটনা বলতে গিয়ে বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে বকর মিয়া'র। অল্প কিছু হারিয়েও সবকিছু হারিয়েছেন তিনি, অথচ যার দোকানে বসে অ্যাতো কথা হলো সেই মিনা কাজী সময়ের সাথে ফুলে ফেঁপে সম্পদের ডাল পালা ছড়িয়ে বিশাল বট গাছে পরিণত হয়েছে। "র‍্যাশন ব্যবসা" ও করেছেন অনেক। স্থানীয় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত তার জমিতে। যতোদিন বেঁচে ছিলেন ততোদিন এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তি হিশেবেই কাটিয়েছেন। তার মুখের উপর কথা বলার কেউ ছিলো না, তবে অ্যাখন আছে। আমরা তাকে বলি মইন্যা রাজাকার। তার দোকানের নাম মইন্যা রাজাকারের দোকান।