যে কারণে পাকিস্তান ক্রিকেট টীম সমর্থন করবো না
কাফি রশিদ, ৫/১০/১২
হুম,
খেলা অবশ্যই আনন্দের বিষয়, সমসময়ই আনন্দের বিষয়। যখন আপনি আপনার বন্ধুদের
সাথে লুডু খেলেন, কাউন্টার স্ট্রাইক খেলেন। সম্মানের বিষয়ও, যখন দাবা
খেলেন। অলিম্পিকে সিনক্রোনাইজড সাঁতার শৈল্পিক বিষয়ও বটে। প্রফেশনাল
গলফারের কাছে খেলাই ক্যারিয়ার, খেলা-ই তাকে টাকা-পয়সার সাথে মানসম্মান এনে
দেয়। বার্সেলোনা, আর্সেনালের খেলাও আনন্দের, ঐখানে ক্লাবের চাকচিক্য
দেখানোটাও ফ্যাক্ট। এইসব খেলায় ব্যক্তি পরিচয়টাই মুখ্য, কোন কোন ক্ষেত্রে
ব্যক্তির দেশটাও উঠে আসে পরিচয় হিশেবে। কেউ কিন্তু বলে না বাংলাদেশের পিকলু
ইংল্যান্ড প্রবাসী আগডুম সাহেবের মেয়ে প্রজাপতিকে দাবা খেলায় হারিয়েছে,
অথবা ঘানা'র নাগরিক জ্বলন্ত ম্যানচেষ্টার সিটির হয়ে খেলে কেনিয়ার নাগরিক
পম্পার ক্লাব ঢাকা মোহামেডানকে হারিয়েছে।
দেশ
কি কখনো খেলতে পারে? দেশের তো হাত-পা নাই, কীভাবে খেলবে? আবার খেলা তো
খেলা-ই, খেলার সাথে দেশপ্রেম, রাজনীতির কী সম্পর্ক? নাহ, এইসব খেলার সাথে
দেশপ্রেম, রাজনীতির কোন সম্পর্ক নাই। কিন্তু টীমভিত্তিক খেলা, য্যামন আমার
এলাকার ফুটবল টীম যখন আমাদের থেকে চাঁদা নিয়ে পাশের এলাকার টীমের সাথে
খেলে, তখন অবশ্যই আমাদের এলাকা খেলে। এখানে আমাদের সমর্থনই "আমাদের এলাকা",
পাশের এলাকার মানুষ সবসময়ই বলবে অমুক এলাকার মানুষ, বলবেনা তমুক খেলোয়ারের
এলাকার মানুষ। আমাদের দেশ যখন এগারোজন খেলোয়ারকে স্পন্সর করে, তখন তারা
শুধু "ব্যক্তি সাকিব, আশরাফুল, তামিম, নাসির" হিশেবে খেলে না, খেলে
"বাংলাদেশের খেলোয়ার" হিশেবে, তারা পৃথিবীর সব মানুষের সমর্থনে খেলে না,
খেলে শুধু বাংলাদেশের মানুষের সমর্থনে। দেশ যখন তাদের সবরকম সুযোগসুবিধা
দেয়, তখন তারা আর ব্যক্তি থাকে না, তারা দেশের অংশ হয়ে যায়। তারা হারলে দেশ
হারে, জিতলে দেশ জিতে। একইভাবে আফ্রিদি, আজমল, হাফিজদেরও পাকিস্তান সরকার
খেলতে পাঠায়, পাকিস্তানের নাগরিকেরা যেই ট্যাক্স দেয় সেই ট্যাক্সের অংশ
আফ্রিদিদের ভরণপোষণে ব্যয় হয়। তারা পাকিস্তানের নামাঙ্কিত জার্সি পরে খেলতে
নামে, তাদের সামনে থাকে পাকিস্তানের পতাকা, তারা পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত
গেয়ে খেলতে নামে। তারা শ্রেফ আনন্দ দেয়ার জন্য খেলে না, তারা খেলে
"পাকিস্তানের হয়ে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল" করতে। খেলা শেষে বলা হয়
না "আফ্রিদি ও অ্যান্ড কোং হেরেছে/জিতেছে", বলা হয় "পাকিস্তান
হেরেছে/জিতেছে"। এই দেশভিত্তিক ক্রিকেটে ব্যক্তিপরিচয় গৌণ, দেশের পরিচয়টাই
প্রধাণ। বাংলাদেশ কিংবা ইংল্যান্ডের কোন খেলোয়ার কিন্তু "টীম পাকিস্তান" এর
হয়ে খেলেনা, টীম পাকিস্তানের জন্য পাকিস্তানী নাগরিক হতে হবে। সবক্ষেত্রেই
"দেশ" চলে আসছে।
কখনো
কি বলা হয় "হাফিজ নেতৃত্বাধীন ১১জন ক্রিকেটার" জিতেছে? যদি তাই বলা হতো
তাহলে আমার আপত্তির কিছু ছিলো না, কিন্তু বলা হয় "পাকিস্তান" জিতেছে।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার ম্যাচ এতো জমজমাট হয় ক্যানো? দুই দলই শক্তিশালী
বলে? শক্তিশালী দল তো কতোই আছে, শ্রীলঙ্কা-ইংল্যান্ড,
অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা-শ্রীলঙ্কা ম্যাচে উত্তেজনা থাকে না
ক্যানো? ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার ম্যাচ জমজমাট হয় তাদের পূর্বশত্রুতার
জেরে। শত্রুতাটা পুরোপুরিই রাজনৈতিক। আপনি এই দুই দলের ম্যাচে তো
পরোক্ষভাবে "রাজনীতি" ই টেনে আনছেন। তাহলে পাকিস্তান বিরোধিতায় রাজনীতি নয়
ক্যানো?
আফ্রিদি-হাফিজ
তো একাত্তরে ছিলো না, পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্মও একাত্তরে ছিলো না,
তাহলে এখনও পাকিস্তান বিরোধিতা ক্যানো? "পাকিস্তান ক্রিকেট দল" এর বিরোধিতা
ক্যানো? না, তারা ছিলো না, তারা খুনও করেনি, তারা একেবারেই দুধে ধোয়া
মানুষ, আপনি ব্যক্তি আফ্রিদির সাপোর্ট করতেই পারেন, "ম্যারি মি"/"ফাক মি"
বলে চিল্লাতেই পারেন, কিন্তু পাকিস্তানের পাতাকা গালে এঁকে না, ফেইসবুকে
"পাকিস্তান জিতেগা" স্ট্যাটাস দিয়ে আফ্রিদির ছবি শেয়ার করে না। আপনি খেলাকে
শ্রেফ আনন্দ হিশেবে দেখলে আনন্দ হিশেবেই দেখুন, দেশ টানবেন ক্যানো? দেশের
সাপোর্ট করবেন ক্যানো? একাত্তরে যাদের জন্মই হয়নি তাদের ছেড়ে দেয়ার কথা আসে
ক্যানো? আপনি বাংলাদেশ সম্পর্কে পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্মের মন্তব্য
জেনে এই কথা বলেন? "পাস্ট ইজ পাস্ট" কথাটা কতোটা অশ্লীল চিন্তা করে
দেখেছেন? কতটুকু ফাঁকিবাজি, হীনমণ্যতা, পাকিস্তানপ্রেম থাকতে পারে এই
কথাটায় একবার ভেবে দেখেছেন?
হ্যা,
আমার কোন অধিকার নাই আপনার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার, আপনি পাকিস্তান
সমর্থন করেও বাংলাদেশের প্রতি আপনার উত্থলেপরা দেশপ্রেম দেখাতে পারেন,
কিন্তু সেইটা বাংলাদেশী হিশেবে না। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ হিশেবে
দিবাস্বপ্ন দেখে। পাকিস্তানের বিরোধিতা ক্যানো করতে হবে সেই কথা বলে আর
"ত্যানা পেঁচাবো" না। আপনি যদি ধরতে পারেন পাকিস্তান টীম সাপোর্ট করা মানে
পাকিস্তানেরই সাপোর্ট করা, তাহলেই একটু অতীত মনে করে দেখবেন। তাতেই হবে।
আরেকটা কথা, চার দশক আগের কথা যখন ভাববেন তখন প্রশ্ন তুলবেন তখনকার পাক
মিলিটারী'র অপকর্মের সাথে ক্রিকেট খেলা-বর্তমান প্রজন্ম-সাধারণ জনগণের
সম্পর্কটা কোথায়, উত্তর আপনার মাথায়। মিলিটারী দেশের বাইরের কিছু? ক্লু
দিচ্ছি, আপনি যখন বাংলাদেশের নামাঙ্কিত ড্রেস পরবেন, তখন আপনি হবেন
বাংলাদেশের প্রতিনিধি, আপনি যাই করবেন, তাই দেশের উপর বর্তাবে। আর দেশের
উপর মানেই দেশের জনগণের উপর। আপনি যখন মারা যাবেন তখন দেশকে জবাবদিহি করতে
হবে। দেশের তো হাত-পা-মুখ নাই, তাহলে? দেশের মানুষ তো আছে। আপনার অপকর্মের
জন্য গোটা দেশই দায়ী থাকবে, প্রতিপক্ষ চিরকাল দেশকেই ঘৃণা করে যাব। এইটা
তাদের নৈতিক দায়িত্ব।