ঈসা নবি / যিশুর জন্মকথা

ঈসা নবি / যিশুর জন্মকথা
কাফি রশিদ, ২৫/৮/১২

খৃস্ট ধর্মমতে যীশু স্বয়ং ঈশ্বর পুত্র। খৃস্ট ধর্মানুসারীদের মতে ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্নিত মসীহ হলেন যীশু। খৃস্ট ধর্মমতে মসীহ বলতে বোঝায় “ঈশ্বর কর্তৃক অভিষিক্ত”, ইহুদী ধর্মমতে “যিনি ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন”, ইসলাম ধর্মমতেও ইহুদী ধর্মের অনুরূপ, তবে ইহুদী ধর্মানুসারীদের মতে যীশুর মধ্যে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী নবীদের গুণাবলী ছিলো না, আর ইসলাম ধর্মমতে গুণাবলী ছিলো তবে ঈশ্বরের পুত্র না। ইহুদী ধর্মে যীশু’র স্বীকৃতি না থাকলেও ইসলাম ধর্মে যীশুকে ঈসা নবী বলে মান্য করা হয়। যীশু’র শিক্ষা/দর্শনের লিখিত রুপ হচ্ছে “নিউ টেস্টামেন্ট” বা নতুন বাইবেল। ইসলাম ধর্মানুসারে এখনকার বাইবেল “ইঞ্জিল” নামক ধর্মপুস্তকের বিকৃত রুপ মাত্র।

মা-বাবা : যীশু’র মা হলেন ইমরান কন্যা মেরী (মরিয়ম), আর বাবা স্বয়ং ঈশ্বর। যীশুর সৎ পিতা ছিলেন যোসেফ (ইউসুফ)। যোসেফ রাজা ডেভিডের (দাউদ) বংশধর, য্যাকবের (ইয়াকুব) পুত্র।

জন্ম কাহিনী : যীশুর জন্ম সংবাদের ছয়মাস পূর্বের কথা। ইহুদিয়া রাজ্যের এক পুরোহিত ছিলেন জাকারিয়া। জাকারিয়া ছিলেন হারুনের বংশধর। জাকারিয়ার আর তার বন্ধ্যা স্ত্রী এলিজাবেথ, দুইজনই ছিলেন ঈশ্বরভক্ত। একদিন জাকারিয়া প্রার্থনার জন্য প্রদীপ ঠিক করছিলেন, অ্যামন সময় গ্যাব্রিয়েল হাজির। এসে বললেন, ভয় করোনা জাকারিয়া, তোমার প্রার্থনা ঈশ্বর শুনেছেন। তোমার একটি পুত্র সন্তান হবে, তার নাম রাখবে জন (ইয়াহিয়া)। তার আগমনে সবাই খুব খুশি হবে, মায়ের গর্ভে থাকতেই সে পবিত্র আত্মায় পূর্ন হবে। দেখো জাকারিয়া, সে কখনো মদ স্পর্শ করবে না, ইসরায়েলিদের ঈশ্বরের পথে আনবে। পিতার মন পুত্রের দিকে ধাবিত করতে সাহায্য করবে। জাকারিয়া গ্যাব্রিয়েলের কথায় সন্দেহ পোষণ করলেন, বললেন, আমি বুড়িয়ে গেছি, তাছাড়া আমার স্ত্রীর বয়সও অনেক হলো। খানিকটা রাগ করে গ্যাব্রিয়েল বললেন, আমি ঈশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। এই সুসংবাদ দেয়ার জন্য ইশ্বর আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। আর তুমি আমার কথার সন্দেহ পোষণ করেছো। এর শাস্তি স্বরুপ তুমি পুত্র জন্ম নেয়ার আগপর্যন্ত বোবা হয়ে থাকবে। এইদিকে প্রার্থনার জন্য আসা লোকেরা বাইরে বিরক্ত হয়ে অপেক্ষা করছিলো জাকারিয়ার জন্য। কিছুক্ষণ আগে বোবা হয়ে যাওয়া জাকারিয়া বাইরে এসে ইশারায় কিছু বুঝানোর চেষ্টা করলো, তখন লোকেরা বুঝতে পারলো যে জাকারিয়া ইশ্বর হতে কোন দর্শন পেয়েছে। এরপর সরাসরি বাসায় চলে গ্যালো জাকারিয়া। গর্ভধারণের পাঁচমাস পর্যন্ত এলিজাবেথ বাইরে যান নি।

এলিজাবেথের গর্ভধারনের যখন ছয় মাস, তখন জাকারিয়ার কাজিন মেরী’র সাথে যোসেফের বিয়ে ঠিকঠাক। অ্যামন সময় গ্যাব্রিয়েল হাজির। কুমারী মেরীকে গ্যাব্রিয়েল এসে বলে তোমাকে ঈশ্বর আশীর্বাদ করেছেন। মেরী তো আতংকে অস্থির, আবার কি হলো! গ্যাব্রিয়েল বললো ভয় করোনা মেরী, ঈশ্বর তোমার সাথেই আছেন, তিনি তোমাকে দয়া করেছেন। তোমার একটা পুত্র সন্তান হবে। সেই পুত্র হবে স্বয়ং ঈশ্বরের পুত্র। নাম হবে যীশু, যীশু ডেভিডের সিংহাসনে বসবে। য্যাকবের বংশের উপর চিরকাল রাজত্ব করবে। অ্যাতো কথা শুনে হাহাকার করে উঠলেন মেরী, বললেন, আমার তো অ্যাখনো বিয়েই হয়নি, বাচ্চা হবে কিভাবে! উত্তরে গ্যাব্রিয়েল বললেন, তোমার উপর পবিত্র আত্মা ভর করবে, ঈশ্বরের শক্তির ছায়া তোমার উপর পরবে। এতে যে পুত্র জন্মগ্রহন করবে সে হবে ইশ্বরপুত্র। মেরী’র অবিশ্বাস অবস্থা দেখে গ্যাব্রিয়েল আবারো শুরু করলেন, দ্যাখো তোমার আত্মীয়া এলিজা বুড়ো বয়সে গর্ভধারণ করছে। ঈশ্বরের কাছে অসম্ভব কিছু নেই। মেরী এই কথা যোসেফকে জানালেন, যোসেফ মেরীর কথা বিশ্বাস করে মেরীকে লজ্জা থেকে বাঁচাতে ছেড়ে দিবেন ভাবলেন। স্বপ্নে ঈশ্বরের একজন দূত স্বরুপে যোসেফকে দেখা দিলেন, বললেন, ভয় করোনা ডেভিডের বংশধর যোসেফ! মেরীর গর্ভে ঈশ্বরের পুণ্যাত্মা আসছে, ওর নাম রেখো ইমানুয়েল। ইমানুয়েল মানে হলো ঈশ্বর আমাদের সংগে আছেন। কথামত কাজ করলেন যোসেফ। মেরীকে বিয়ে করলেন কিন্তু মিলিত হলেন না। ছেলের জন্ম হওয়ার পর নাম রাখলেন যীশু।

মেরী এরপর ইহুদিয়া গ্রামে কাজিন এলিজা’র কাছে বেড়াতে গ্যালো। এলিজা খুব পুলকিত হয়ে মেরীর সাথে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। আনন্দের আতিসহ্যে মেরীকে বললেন, আমার কি সৌভাগ্য! ঈশ্বরমাতা আমার গৃহে এসেছে। গর্ভে আমার শিশুপুত্র আনন্দে নাচনাচি করছে। নিশ্চয়ই আমি ধন্যা, মেরী ধন্যা। ঈশ্বর যুগ যুগ ধরে ডেভিডের বংশধরের উপর করুণা বর্ষন করে চলেছেন। তিনমাস এলিজা’র কাছে থেকে মেরী বাসায় ফিরে গ্যালো। কিছুদিন পর এলিজা পুত্র সন্তান প্রসব করলো। নাম রাখা হলো জন। পিতা জাকারিয়া’র জবানও খুলে গ্যালো, ঈশ্বরের জয়গান গাইতে লাগলেন।

ইহুদিয়া রাজ্যের সম্রাট ছিলেন অগাস্ট। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তার রাজ্যের গণনা’র জন্য সবার নাম লিখা হবে। নাম লিখাবার জন্য সবাই নিজ নিজ গ্রামে যেতে লাগলেন। রাজা ডেভিডের জন্মস্থান ছিলো ইহুদিয়া রাজ্যের গ্যালিলি প্রদেশের বেথেলহেম গ্রাম। যোসেফ নাজারেথ গ্রাম থেকে বেথেলহেমে রওনা করলেন, সাথে গর্ভবতী স্ত্রী মেরী। বেথেলহেমে থাকা অবস্থায়ই সন্তান প্রসবের সময় চলে আসলো। জন্ম হলো নাজারেথ যীশু’র। গ্রামে তাদের থাকার যায়গা ছিলো না, সদ্য ভুমিষ্ট যীশুকে তাই যবপাত্রে রাখা হলো। এই ঈশ্বরপুত্রই আজ পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে আছেন।

আমার মতে আব্রাহামিক ধর্মসমুহের প্রথমটি দ্বিতীয়/তৃতীয়টিকে মিথ্যা দাবী করলেও দ্বিতীয়টি প্রথমটিকে অথবা তৃতীয়টি প্রথম দুইটিকে স্বীকার করে বিলুপ্ত ঘোষণার রীতি এসেছে কেবল নতুন ধর্মটির গ্রহনযোগ্যতা ও অনুসারী বৃদ্ধির জন্যই। ইব্রাহীমের বংশের প্রায় সবাই ও মেরী’র বংশের কয়েকজন ব্যক্তি খৃস্ট ও ইসলাম, উভয় ধর্মেই স্বীকৃত ও সম্মানিত। ইসলাম ধর্ম তাদের স্বীকৃতি দেয় সেই সাম্রাজ্যবাদী/গ্রহনযোগ্যতার রীতি অনুসারেই, খৃস্ট ধর্ম য্যামন দেয় ইহুদী ধর্ম্প্রচারকদের।

খৃস্ট ধর্ম প্রচারক যীশু'র জন্ম একটি বিতর্কের বিষয়। খৃস্ট ও ইসলাম ধর্মমতে পিতা ছাড়াই কুমারী মাতা মেরীর গর্ভে যীশু’র জন্ম হয়েছিলো। খৃস্ট ধর্মমতে যীশু’র পিতা স্বয়ং ইশ্বর, আর ইসলাম ধর্মমতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তার ক্ষমতা বলে কুমারী মাতার গর্ভে যীশুকে স্থান দিয়েছিলেন।

যীশু’র বংশধরেরা ছিলেন ক্ষমতাবান ধর্মপ্রচারক ও রাজ বংশীয়। মেরী’র সাথে যোসেফ’র (নবী ইউসুফ) বিয়ে যখন ঠিকঠাক, তখনি মেরী’র গর্ভে সন্তান এলো। বিন্দুমাত্র বাস্তব জ্ঞান থাকলে যে কেউই স্বীকার করবে স্বামী ছাড়া কেবল ইশ্বরের আশীর্বাদে সন্তানের জন্ম সম্ভব না। যোসেফের সাথে অবশ্যই মেরী’র বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক ছিলো। যার ফলে মেরির গর্ভে সন্তান আসে। ক্ষমতাশালী পরিবার হওয়ায় ব্যাপারটা ইশ্বরের ইচ্ছা বলে চালিয়ে দিয়ে মেরী-যোসেফ সহ তাদের পরিবার পার পেয়ে গিয়েছিলো। কেননা ইব্রাহীমের বংশের কোন পুরুষের লাম্পট্য কোনভাবেই গ্রহনযোগ্যতা পেত না। যোসেফের নিজ বংশীয় ডেভিডের প্রচারিত ধর্মে মসীহের আগমনের সংবাদ ছিলো। সুচতুর যোসেফ আর মেরী পরিবারের অন্যদের সহায়তায় রটিয়ে দিলো গর্ভে আসা সন্তানই হবে সেই মসীহ। যীশু নাম নিয়ে সে ঈশ্বরের সত্য ধর্ম প্রচার করবে। ঐসময় এলাকার কিছু মানুষ আপত্তি তুললে মেরী ও যোসেফ বেথেলহেমে চলে যায়, সেখানেই জন্ম হয় যীশু’র। যোসেফের সাথে মেরীর বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেই কিন্তু মেরী গর্ভবতী হয়। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারনেই বিয়ে ঠিক হয়েছিলো কিনা তাই বা কে জানে। ততকালীন সময়ে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক দুধ ভাত হলেও মেরী-যোসেফের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হেলাফেলার বিষয় ছিলো না। কারন মেরীর পিতা য্যাকব, বোন এলিজাবেথ ও জামাই যাকারিয়াও ধর্ম প্রচারক ছিলেন। এই বিষয়ে আর মন্তব্য করছি না।

আমরা বহু আগে থেকেই জানি শুধুমাত্র পিতা অথবা মাতা হতে সন্তান জন্ম সম্ভব না। ছেলে সন্তানের জন্য যেই সেক্স ক্রোমোসোম Y লাগে তা শুধুমাত্র পুরুষ হতেই পাওয়া সম্ভব। যেহেতু খৃস্ট ধর্মমতে কোন পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ছাড়াই কেবল মেরী হতে যীশু’র জন্ম হয়েছিলো, আর তিনি ইশ্বর পুত্র, তাই এই গাজাখুরি কথার পিঠে বলা যায় স্বয়ং ইশ্বরের সাথে মেরীর সম্পর্ক ছিলো, ইশ্বরের শুক্রানু থেকেই যীশু’র জন্ম। তাহলে আবার "নিরাকার" ইশ্বরের তত্ত্ব টিকেনা। আরেকটা কথা বলা যায় মেরীর শরীরেই ডিম্বানু ও শুক্রানু উৎপন্ন হয়েছিলো, তা নিষিক্ত হয়েই যীশু’র জন্ম। স্বাভাবিক কোন নারীর পক্ষে এইসব অসম্ভব ব্যাপার। ধর্মীয় মতেও আবার এই যুক্তি টিকেনা। কারন মেরীকে সবচেয়ে নিখুঁত নারী হিসেবেই খৃস্ট ধর্মাবলম্বীরা মানে, ইসলাম ধর্মের ধর্মগ্রন্থ কোরআনেও মেরীকে একমাত্র নিখুঁত নারী বলা হয়েছে (দ্রষ্টব্যঃ সহিহ্‌ মুসলিম, বই ৩১, হাদিস ৫৯৬৬)। হয় যোসেফের সাথে মেরীর যৌন সম্পর্ক ছিলো, অথবা তার পরিবারেরই কারো সাথে! বড় হয়ে যীশু যে ইশ্বর পুত্র হিসেবে বিভিন্ন মাজেজা দেখিয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন, তাও কিন্তু না। তার অলৌকিক কর্মকান্ডের মধ্যে পানির উপর দিয়ে হাটা, ৫০০০ মানুষকে খাওয়ানোর কথাই বেশী শোনা যায়। যীশু সাধারণ মানুষজনকে নৈতিক শিক্ষা আর ঐশ্বরিক আদেশ বিষয়ক শিক্ষা দিয়েছেন কেবল। খৃস্ট ধর্মমতে যীশু’র মৃত্যু হয় ক্রুশবিদ্ধ হয়ে। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সময় তাকে নিয়ে ঠাট্টা করা হয় অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে ব্যর্থ হওয়ায়।

যীশু’র জন্মের প্রায় ছয়শো বছর পর আরবে মুহম্মদের উপর কোরআন নাজিলের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের প্রচলন ঘটে বলে মুসলিমরা বিশ্বাস করে। মুহম্মদ এসে দাবী করে দাউদ, মূসা ও ঈসা কর্তৃক প্রচলিত ধর্মের অনুসারীরা আল্লাহ্‌র পথে যায়নি। তাদের ধর্মগ্রন্থসমূহ বিকৃত করা হয়েছে। মুহম্মদ নিজেকে শেষ নবী ও ওহীপ্রাপ্ত বলে দাবী করে। কিন্তু তিনি ঈসা কে ইশ্বরপুত্র বলেননি। কোরআনেও আল্লাহ্‌ ঈসাকে নিজের পুত্র না বলে দোয়াপ্রাপ্ত বলেন। সম্ভবত ঈসা’র জন্ম নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে মুহম্মদ তোপের মুখে পরতে চাননি। কোরআনে দাবী, ক্রুশবিদ্ধ হয়ে ঈসা’র মৃত্যু হয়নি। প্রার্থনাকালে ঈশ্বর তাকে তুলে নিয়েছিলেন। একদিকে মুহম্মদ তৎকালীন খৃস্টানদেরও খুশি রাখলেন, আবার নিজেকে ঈসা’র উত্তরসূরিও দাবী করলেন। ঈসা য্যামন নিজেকে মসীহ দাবী করে ইহুদীদের স্বীকৃতি পাননি, মুহম্মদও ত্যামন নিজেকে শেষ নবী দাবী করে খৃস্টানদের স্বীকৃতি পাননি। লাভ যা হয়েছে তা হলো ঈসা কে জারজ না বলায় তাকে হত্যা করা হয়নি, খৃস্ট ধর্মের গোঁজামিলের কারনে নিজেকে শেষ নবী দাবী করতে পেরেছেন।

অ্যাখনকার সময়েও মুসলমান খৃস্টান কেউই যীশু/ঈসা কে নিয়ে প্রশ্ন তুলে না। অন্তত বাঙালী মুসলমান-খৃস্টানেরা। তাতে দুই ধর্মেরই ক্ষতি। বর্তমান কালের ধর্মীয় স্কলারদের কাছেও এই ব্যাপারটা বিব্রতকরই বটে।