আমাদের গ্রামের কয়েকজন সাধারণ মানুষ ও একজন মইন্যা রাজাকারের কথা। দ্বিতীয় পর্বঃ পুতুলরানী

আমাদের গ্রামের কয়েকজন সাধারণ মানুষ ও একজন মইন্যা রাজাকারের কথা। দ্বিতীয় পর্বঃ পুতুলরানী
কাফি রশিদ, ২৭/১১/১২

আমাদের বার-বাড়ির মাঝখানে সাপের মতোন পেঁচিয়ে উঠা আম গাছটার সবচে নিচু ডালে চরে বসে সোজা দক্ষিন দিকে তাকালেই কুমোরদের ভিটে চোখে পরতো। একটু উচু হয়ে উঁকি দিলেই মেটে রঙের মূর্তি বোঝাই আধ-খোলা ঘরটাও দ্যাখা যেত। কুমোরদের কোন লজ্জা-শরম নাই, ক্যামন চেহারার ন্যাংটা মেয়েমানুষের মূর্তিগুলো রোদে পোহাতে দাড় করিয়ে রাখতো। পরে জেনেছি সেগুলো মা দূর্গা'র প্রতিমা। মা দূর্গাও ক্যামন বেহায়া, কেতু কুমোরের কানে কানে একটু বলে দিলেই পারতেন দিনের বেলায় কাপড় জড়িয়ে রাখতে। গ্রামে গ্যালে ফুফু আর আম্মুর সাথে প্রায়ই কুমোর বাড়িতে যেতাম এটা-ওটা কিনতে, উদ্দেশ্য বিশালাকার প্রতিমাগুলো সামনে থেকে দ্যাখা। কিন্তু প্রায়ই প্রতিমা-ঘরের সামনে পর্যন্ত পৌছুতে পারতাম না, বিড়বিড় করতে করতে তেড়ে আসতো পুতুলরানী, যদিও তার সুরক্ষিত দূর্গের মতোন বাড়িটা ছিলো আরো অনেক দূরে। মাঝে মধ্যে মাটির ডেলাও ছুড়ে মারতো।

আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি অ্যাতোদিন তার নাম তার মা-বাবা ছাড়া অন্য কেউ জানতো না। হয়তো বোনের নাম কেতু কুমোরও ভুলে গিয়েছিলেন। অ্যাখন গ্রামের প্রায় সবাই জানে তার নাম। ঘটনা বড়ো চমকপ্রদ। আমি তো এই কয়দিনের ছেলে, আমার বাবাও নাকি ছোটবেলায় পুতুল রানীকে দেখেছে বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ভিক্ষা করে খেতে, সে আজকের দিনের মানুষ, না রীতিমতো ফসিল ভিক্ষুক। মোসলমানের ঘরের ভাত খেলে নাকি জাত যায়, একারণেই সম্ভবত তার আত্মীয়রাও তাকে ভালো চোখে দেখতো না। তবে অ্যাখন দ্যাখে।

আমি তো আমি, কেতু কুমোরও কেউ বলতে পারে না তার পূর্বপুরুষের পেশা মাটি গুলিয়ে, ছেনে, শুকিয়ে হাড়ি আর ন্যাংটা মূর্তি গড়া ভিন্ন অন্য কিছু ছিলো কিনা। সারা গ্রামে একটাই কুমোর-বাড়ি। কদরও তাই একটু বেশিই। এই কদরের কারণেই কিনা কে জানে, বোনের বিয়ে দিয়েছিলেন ফকিরবাড়ির ম্যালা আর বাঙলাবাজারে বাতাসা আর বিড়নি চালের খইয়ের ব্যবসা করা এক রাজপুত্তুর বিকাশের সাথে। সুন্দরীপাড়া'র জামাইবাড়িতে গিয়ে য্যানো পাড়া'র নাম রাখতেই দিনে দিনে আরো সুন্দরী হয়ে উঠছিলেন পুতুল রানী। ইতোমধ্যে পুত্র সন্তানের আশায় দুই-দুইটি মেয়েরও জন্ম হয়েছে। সুখের গল্পই শেষ পর্যন্ত সুখের থাকে না, আর এটাতো বাস্তব ঘটনা। খই ভাজতে কলা গাছের মাঝখানের কান্ডটা কেঁটে আনতে গিয়ে কী এক সাপের কামড় খেয়ে মদন ওঝার বাড়িতে এসে মারা পরলেন পুতুলরানী'র স্বামী।

শুধু যে মারা পরলেন তা না, একেবারে সহায়-সম্বলহীন করে গেলেন। ভাইদের সহযোগীতায় দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গ্যালো। কিছুদিন দুই মেয়ের বাড়িতে পালা করে থাকা খাওয়া চালিয়ে গেলেন, তারপর কিছুদিন ভাইয়ের বাড়ি, কিছুদিন বোনের বাড়ি করে কাটিয়ে তাদের বিরক্তি উৎপাদন করে নিজের বসতভিটা বিক্রি করে দিলেন অল্পমূল্যে। তারপর পাশের পাড়া'র শিলাকোঠা'র এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী'র বার-বাড়িতে শনের ঘরতুলে থাকতে শুরু করলেন। কয়েকবছর ভালোই কাটালেন বাড়ি বিক্রির টাকায়, এরপর উপায়ন্তর না দেখে ভিক্ষা করতে নেমে গেলেন। সে অনেকদিন আগের কথা।

সারাদিন এ-বাড়ি ও-বাড়ি করে একমুঠোচাল, একমুঠোডাল নিয়ে দুপুরে বাসায় ফিরতেন। তবে তাকে কেউ দ্যাখেনি সেই চাল ডাল দিয়ে রান্না করে খেতে, সেগুলো বিক্রি করতো না ফেলে দিতো কে জানে, সারাদিন শুধু চিড়া-মুড়ি খেতো। হয়তো সেই চাল-ডাল বিক্রি করেই চিড়া-মুড়ি কিনে আনতেন। তার যুক্তি ছিলো চিড়া-মুড়ি আর অল্প পানিতেই পেট টইটম্বুর হয়ে যায়। মায়ের অ্যামন অবস্থা দেখে মেয়েরা বিয়ের পর আর সে বাড়িতে পা দেয়নি। ধর্মে হিন্দু হলেও পরিচিত হওয়ায় মোসলমানের ঈদেও নতুন শাড়ি পেতেন, সাথে নগদ টাকাও। অথচ সেই শাড়ি কখনো পড়ে দ্যাখেননি।

প্রায় ছয়মাস আগে পুতুলরানী মারা যান, স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিলো তার। নিজের যাবতীয় সম্পত্তির ব্যাপারে অতিরিক্ত সাবধানতা ছিলো তার। অজানা কারো ভয়ে ভিক্ষা করতে গ্যালে দরজা দুইটি তালা দিয়ে যেতেন, সারাদিনে দুইবার বাসায় আসতেন - দুপুরের শেষদিকে, আর রাতে ঘুমাতে। ভিক্ষা শেষে বাকীটা সময় ভাইয়ের বাড়ি আর তার ঘরের মাঝখানের প্রতিমা-ঘরের সামনে বসে থাকতেন। তার অনুপস্থিতিতে তো অসম্ভব ব্যাপার, তার উপস্থিতিতেও তার ঘরে কেউ প্রবেশ করার সাহস পায়নি। সেদিন সকালে তার কোন রা' না পেয়ে এলাকার মানুষজন দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে তাকে মৃতাবস্থায় দেখতে পায়। তার মৃত্যুর চেয়েও যে ব্যাপারটা অবাক হওয়ায় মতোন ছিলো, তা হলো তার ঘরের ভিতরে রাখা ৩টি ধামা ভরা চাল, ৪টিন সয়াবিন তেল, নতুন প্রায় ২০০টি শাড়ি, বিছানার নিচে আর শনের বেড়া'র ফাকফোকরে গুজে রাখা টাকা, একশ-দুইশ না, প্রায় দেড় লাখ টাকা! যেদিকে হাত দেয়া যায় খুচরা টাকা ঝুরঝুর করে পরে। কী ভেবে এসব জমিয়েছিলেন তা জানার উপায় অ্যাখন নাই।

এতোদিন যার কোন খবর কেউ নেয়নি, সেদিন তার খবর নেয়ার মানুষের অভাব হয়নি। ভাই-মেয়ে থেকে শুরু করে যার বার-বাড়িতে থাকতেন, সে পর্যন্ত টাকার ভাগের দাবী তুলেছেন। তার যুক্তি ছিলো এতোদিন বিনা-ভাড়ায় থাকতে দিয়েছেন তার অভাবের কথা চিন্তা করে, এখন তো তার অভাব নেই। কাজেই বকেয়া ভাড়া বাবদ তিনিও কিছু টাকার প্রাপক। ব্যাপারটা ভালো দ্যাখায় না, তাই এবার নতুন ফন্দি করলেন। ঘোষণা করলেন তার প্রাপ্য টাকা তিনি পাড়া'র মসজিদে দান করে দিয়েছেন। হিন্দুর টাকায় মোসলমানের মসজিদ? ব্যাপারটা শেষমেষ তাই-ই দাড়ালো। নগদ বিশ হাজার টাকা দান করা হলো সেই মসজিদে। মসজিদটি আর কারো নয়, বার-বাড়ি ভাড়া দেয়া মালিকেরই। ঘরটিও তার নিজের আয়ত্বেই রইলো, চাল-ডাল-শাড়ি আর বাকী টাকা পুতুলরানীর মেয়েদের দিয়ে দেওয়া হলো।

পুতুলরানী না থাকলেও সেই ঘরটি অ্যাখনো আছে, সেটি এখন বাহারী দোকানঘর। নামে কাজীর দোকান হলেও আমরা বলি মইন্যা রাজাকারের দোকান। হিন্দুর উপাসনালয় না হলেও হিন্দুর টাকায় মসজিদের বাইরের দেয়ালটি তরতর করে উঠে গ্যালো। জুম্মাবারে নিয়মিত দোয়া পেতে থাকলো মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা, অধুনা বিশ হাজার টাকা মসজিদে দানের ঘোষণাকারী মিনা কাজী, আমরা খুব উৎসাহের সাথে জুম্মাবারে নামাজ পড়তে যাই, নামাজ শেষে মনে মনে দোয়া করি মইন্যা রাজাকার আজীবন নরকে জ্বলে মরুক, বাকি হাজারো মইন্যা রাজাকার শিঘ্রই ফাঁসিতে ঝুলে মরে সঙ্গ দিক তাকে।