কোথা থেকে এলো আমাদের বাঙলা বর্ণমালা?

কোথা থেকে এলো আমাদের বাঙলা বর্ণমালা?
কাফি রশিদ, ১৪/১১/১২

আমরা যেসব সুন্দর সুন্দর অক্ষর বা বর্ণ দিয়ে লেখালেখি করি সেই অক্ষর বা বর্ণ এলো কোথা থেকে? কে তৈরি করেছিলেন এইসব বর্ণ? কতো বছর আগে তিনি এইসব তৈরি করেছিলেন? আমরা এইসব প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর পাবো না। কেউ লিখে রাখেনি আমাদের প্রাণের বাঙলা বর্ণমালা কে তৈরি করেছিলেন। যদি জানা যেত তাহলে আমরা নিশ্চয়ই তাকে বাঙলা ভাষার দেবতার আসনে বসাতাম। সরাসরি উত্তর না পাওয়া গেলেও ধারণা করা যায় আমাদের বর্ণমালা’র আবিষ্কারকাল, উৎস। আমরা এখন যেরকম দেখি আমাদের বর্ণমালা, ঠিক সেইরকম ছিলো না প্রথম দিকের বর্ণমালা। হাজার বছরের পথ পাড়ি দিয়ে এতো সুন্দর ঝকঝকে হয়েছে বাঙলা বর্ণমালা।

প্রাচীন কাল থেকে পাঁচটি স্তর পার হয়ে আধুনিক বর্ণমালা এসেছে। তখন কোন বর্ণমালা ছিলো না, গাছপালা-মানুষ-প্রাণী’র ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করা হতো। এটা হচ্ছে বর্ণমালার প্রথম স্তর – “গ্রন্থিলিপি”। আনুমানিক দশ-বারো হাজার বছর আগে মানুষ গ্রন্থিলিপি দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করতো। এরপর এলো “ভাবলিপি” - সম্পুর্ন ছবি না এঁকে সংকেত বা চিহ্ন বা প্রতীকের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যম। ভাবলিপি ছিলো অনেকটা এমনঃ দিন বোঝাতে পূর্ন বৃত্ত, অর্থাৎ সূর্য আঁকা হতো, আর রাত বোঝাতে অর্ধ বৃত্তের সাথে তাঁরা আঁকা হতো। এরপর এলো তৃতীয় স্তর – “শব্দলিপি”, এই স্তরে ব্যাপক হারে ছবি’র বদলে চিহ্নের ব্যবহার হতে লাগলো। শব্দলিপি আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে এলো চতুর্থস্তর – “অক্ষরলিপি”। অক্ষরলিপি আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে পঞ্চম স্তর হিশেবে এলো “ধ্বনিলিপি”। এই ধ্বনিলিপি থেকেই আধুনিক বর্ণমালার উৎপত্তি। সেইসময় বিভিন্ন বর্ণে বা রঙে বিভিন্ন অক্ষর লিখা হতো, সেখান থেকেই অক্ষরের নাম হয়েছে বর্ণ, বর্ণমালা।


ব্রাহ্মীলিপি’র নমুনা, গিনার পর্বতে প্রাপ্ত।

আমাদের বাঙলা বর্ণমালা এসেছে প্রাচীন ভারতীয় “ব্রাহ্মীলিপি” থেকে। পৌরাণিক উপকথামতে হিন্দু দেবতা ব্রহ্মা ভারতবর্ষের প্রাচীন লিপি আবিষ্কার করেছিলেন এবং ধ্বনির সাথে মানুষকে এই লিপি দান করেছিলেন, তার নামানুসারে ঐ লিপির নাম হয় ব্রাহ্মীলিপি। কেউ কেউ বলেন, বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণরা ছিলেন শ্রেষ্ঠ পুরোহিত। ব্রাহ্মণদের দ্বারা এই লিপি আবিষ্কৃত হয়েছিল বলেই এর নাম ব্রাহ্মীলিপি। যে যাই বলুক, ভারতবাসী নিজেরাই সৃষ্টি করেছিলেন ব্রাহ্মীলিপি। ব্রাহ্মীলিপির পেছনে ফিনিশীয় লিপির প্রভাব আছে বলে দাবী করা হয়। তবে প্রাচীন ভারতীয়রা সম্ভবত স্বাধীনভাবেই নিজেদের লিপি উদ্ভাবন করেছিল – কারণ ফিনিশীয় লিপির চেয়ে ব্রাহ্মীলিপির পার্থক্য অনেক। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে ব্রাহ্মীলিপি প্রচলিত ছিল। এরপর “অশোক লিপি” বা “মৌর্য লিপি” তে এর বিবর্তন শুরু হয়। এর পরের ধাপে আসে “কুষাণ লিপি”, এগুলি কুষাণ রাজাদের আমলে প্রচলিত ছিল। এরপর ব্রাহ্মীলিপিটি উত্তরী ও দক্ষিণী - এই দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তরী লিপিগুলির মধ্যে পূর্বদেশীয় গুপ্তলিপি প্রধান, এটি ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দীতে প্রচলিত ছিল। গুপ্তলিপি থেকে আবির্ভাব হয় “কুটিল লিপির”, এটি ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। কুটিল লিপি থেকে উদ্ভব হয় নাগরী লিপির। প্রাচীন নাগরী লিপির পূর্ব শাখা থেকে ১০ম শতকের শেষভাগে এসে উৎপত্তি হয়েছে বাঙলা লিপির। অর্থাৎ ব্রাহ্মীলিপি > অশোক লিপি বা মৌর্য লিপি > কুশাণ লিপি > উত্তরী গুপ্তলিপি (পূর্বদেশীয়) > কুটিল লিপি > নাগরী লিপি > বাঙলা লিপি।

ব্রাহ্মীলিপি থেকে সৃষ্ট বাঙলা বর্ণমালা দেখতে কিন্তু এখনকার বর্ণমালার মতোন ছিলো না, সময়ের পরিবর্তনে বর্ণ’র চেহারারও পরিবর্তন হয়েছে। আগে তো ছাপাখানা ছিলো না, শুদ্ধতা বজায় থাকবে কী করে? তখন মানুষ হাতে কাব্য লিখতো, পুঁথি লিখতো। একেকজনের হাতের লেখা একেকরকম, দশজন দশরকম করে "ক" "খ" লিখেছে। এভাবেই পরিবর্তিত হতে হতে পাল্টে গেছে বাঙলা বর্ণমালা। কম্বোজের রাজা নয়পালদেবের ইর্দার দানপত্রে এবং প্রথম মহীপালের বাণগড়ের দানপত্রে সর্বপ্রথম আদি বাংলা বর্ণমালা দেখতে পাওয়া যায়। ব্রাহ্মীলিপি’র প্রথম পাঠোদ্ধার করেন প্রাচ্যবিদ্যা-বিশারদ প্রিন্সসেপ। আমাদের দেশের সিলেট’র উপভাষারও কিন্তু বর্ণমালা ছিলো, আধুনিক বাঙলা বর্ণমালা থেকে একটু আলাদা, প্রায় অবিকৃত নাগরীলিপি’র মতোন।

এখন পর্যন্ত তিন ধরণের ব্রাহ্মীলিপির নমুনা আবিষ্কৃত হয়েছে, যাতে ৪৪টি বর্ণ পাওয়া যায়। এরমধ্যে স্বরবর্ণ ৯টি, ব্যাঞ্জনবর্ণ ৩৫টি। বাঙলা বর্ণমালার “ঔ” ও “ঋ” ব্রাহ্মীলিপির স্বরবর্ণে না পাওয়া গেলেও ব্যাঞ্জনবর্ণে এ দুটি বর্ণের নমুনা পাওয়া গেছে। আমরা এখন যে কয়টি স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ দেখি, আগে এরচে কয়েকটি বেশি ছিলো। এই তো কিছুদিন আগেও স্বরবর্ণতে ৯ ছিলো, এখন আর ৯’র অস্তিত্ব নেই। এর সাথে ছিলো ৠ। ব্যঞ্জনবর্ণতে ছিলো ল (মূর্ধন্য ল), ছিলো হ্ল (মহাপ্রাণ ল), ছিলো ব (অন্তঃস্থ ব)।


ন্যাথলিয়েন ব্র্যাসি হ্যালহেড এর “এ গ্রামার অফ দ্যা বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ”

যুগে যুগে বাঙলা বর্ণমালার আকার-আকৃতি বদলাতে বদলাতে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে মোটামুটি স্থির রুপ পায়, মুদ্রণযন্ত্রের ঢালাই ধাতুতে তৈরি বর্ণের কল্যাণে। তবে সেগুলো কিন্তু বাঙলা ভাষা-ভাষীরা করেননি, সেগুলো করেছিলো ইউরোপীয়রা। এর আগে, ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডাম থেকে প্রকাশিত “চায়না ইলাস্ট্রেটা” নামক বইয়ে বাঙলা বর্ণমালা’র নমুনা ছাপা হয়েছিলো। ১৬৬৭ সালের পর আরো একটি বইয়ে বাঙলা বর্ণমালা’র নমুনা ছাপা হয়, ১৭৪৩ সালে লাইডেন থেকে প্রকাশিত “ডিসারতিও সিলেকটা” নামের বইয়ে। এই নমুনা বর্ণগুলো ব্লকের তৈরী হরফে ছাপা হয়েছিলো। ১৭৭৮ সালে ন্যাথলিয়েন ব্র্যাসি হ্যালহেড হুগলী থেকে বাঙলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ প্রকাশ করেন – “এ গ্রামার অফ দ্যা বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ”। বইটি রোমান হরফে লিখলেও উদাহারণগুলো ছেপেছিলেন বাঙলা বর্ণমালায়। আগে ছাপা হয়েছিলো ব্লকে, এবার ছাপা হয় ধাতব কী-তে। প্রতিটা বর্ণের জন্য আলাদা আলাদা ধাতব কী।


ভিতরের পেইজে বাঙলা ও ইংরেজি। চমৎকার না?

হ্যালহেডকে এই কাজে সহায়তা করেন পঞ্চানন কর্মকার। বর্ণগুলো দেখতে ছিলো আকারে বড়ো, এখনকার বর্ণের চেয়ে একটু আলাদা, তবে অত্যন্ত সুশ্রী ও সাজানো-গোছানো। পঞ্চানন কর্মকার ও হ্যালহেড স্থির করে দিয়ে গেলেন বাঙলা বর্ণমালার রূপ। এরপর মুদ্রণযন্ত্রের প্রয়োজনে ও উৎসাহে আরো সুশ্রী হয়েছে বাঙলা বর্ণমালা। তৈরি হয়েছে মনো ও লাইনো রুপসী অক্ষর। তৈরি হয়েছে কয়েকটি নতুন অক্ষর, যুক্তাক্ষর পাল্টেছে মনো ও লাইনো টাইপের কল্যাণে।


বইয়ের ভিতরের আরেক অংশ।

সূত্র :
উইকিপিডিয়া, কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী – হুমায়ুন আজাদ।