অন্তর্জাল-ভিত্তিক নাস্তিকতার চর্চা কোন পথে?

অন্তর্জাল-ভিত্তিক নাস্তিকতার চর্চা কোন পথে
কাফি রশিদ, ১৯/১১/১২

ধর্মের পক্ষে-বিপক্ষে যতো তর্ক-বিতর্ক, তার ৯৫% ই সম্ভবত ব্লগ আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটেই হচ্ছে, কারণ হিশেবে যে কয়েকটি বিষয় বলা যায়, যার প্রধান হবে নিরাপত্তা, পরেরটি হবে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা, ক্রমান্বয়ে আসবে গতি, তথ্য-উপাত্ত'র সহজলভ্যতা ইত্যাদি। ধার্মিকেরা যেভাবে প্রকাশ্য জনসভায় তাদের ধর্মের কথা বলতে পারেন, ধর্মের দাওয়াত দিতে পারেন, সেভাবে কোন নাস্তিকের পক্ষে নাস্তিকতার স্বপক্ষে বয়ান অ্যাখন পর্যন্ত এই বাংলাদেশে সম্ভব না। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, যিনি অ্যামন দুঃসাহস দেখাবেন পরদিন তাকে আর্মি-সোয়াট সাথে নিয়ে চলাফেরা করতে হবে। ধার্মিকদের সহনশীলতা অতিরিক্ত কম হওয়ায় অন্তর্জালই সবচে’ নিরাপদ স্থান ধর্মের বিপক্ষে কথা বলার।

যারা ব্লগে, ফেইসবুক সহ অন্যান সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে লেখালেখি করেন, তারা নিশ্চয়ই সাধারণের চেয়ে একটু হলেও বেশি শিক্ষিত, একটু বেশি সচেতন। কাজেই তারা সাধারণের চেয়ে একটু বেশি সহনশীল হবে অ্যামনটা আশা করা ভুল হবে না। আসলে ছিলোও তাই। এটা তাদের শিক্ষার কারণে হয়েছে নাকি "নিরাপত্তার" কারণে হয়েছে তা নিয়ে বিপক্ষমত থাকতেই পারে। ধরে নিচ্ছি শিক্ষাটাই এখানে মূখ্য। অন্তর্জাল ছাড়া এদেশে যেহেতু প্রত্যক্ষ্যভাবে নাস্তিকতার প্রসারের কোন সুযোগ নাই, তাই বই-পত্র ছাড়া অন্যদের প্রভাবিত করার অন্য কোন উপায় নাই। কয়েকজন যদি পরস্পরের পরিচিত হয়, তাহলে তারা একসাথে বসে আলোচনা চালাতে পারেন, বাকিদের পক্ষে দুরুত্ব, পরিচয় ইত্যাদি কারণে সামনাসামনি বসে আলোচনা সম্ভব না। প্রত্যেকের মতামত ছড়িয়ে দেয়াই তাই উত্তম। সারা দুনিয়ার নাস্তিকেরা তাদের মতামত অন্তর্জালে ছড়িয়ে দিচ্ছে ব্লগ, সোশ্যাল সাইটের মাধ্যমে, ফলে আলোচনা-সমালোচনার প্রধান হয়ে পরেছে অন্তর্জাল। অন্তর্জাল ছাড়া তাই আপাতত নাস্তিকতার চর্চা প্রায় গতিহীন।

বাঙলা ব্লগের শুরুতে যারা ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করতেন আর যারা তাদের সমর্থন করতেন, তারা সবাই-ই চেষ্টা করতেন যুক্তির দ্বারা আস্তিকদের ঘায়েল করতে, হয়েছেও তাই। তখন যেহেতু তূলনামূলকভাবে বেশি শিক্ষিতরা, অপেক্ষাকৃত বয়স্করা লিখতেন, রিঅ্যাকশনও ছিলো তাই সহনীয় পর্যায়ে। অন্তর্জালের প্রসার ও সহজলভ্যতার কারণে গত কয়েকবছরে ব্লগার-ফেইসবুকারের সংখ্যা বেড়েছে কয়েক'শ থেকে কয়েক হাজার গুন। এর মধ্যে যারা ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করেন, তাদের বেশিরভাগই হিটাকাঙ্খী, কেউ নিজের প্রসার-প্রার্থী, অতি অল্প সংখ্যক পরের হিতাকাঙ্খী। ইস্কুলের ছাত্ররাও ব্লগিঙ করছে, রিটায়ার্ড অফিসারও ব্লগিঙ করছেন। ব্লগ-ফেইসবুকে ধর্মের আলোচনা-সমালোচনা বেড়েছে, কিন্তু সহনশীলতা, যুক্তির প্রয়োগ বিন্দুমাত্র বাড়েনি। উল্টো আস্তিক-নাস্তিক উভয়ের সহনশীলতা কমছে ইউজারের সংখ্যাবৃদ্ধির সাথে।

অনেকের মনের ভেতর সন্দেহ ছিলো, অন্তর্জালে এসে সন্দেহ দূর হয়ে পুরোপুরি ধর্ম ত্যাগ করেছেন। সন্দেহ দূর হয়ে ধার্মিক হয়েছেন অ্যামন নজির নাই। ব্যাপারটা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে কিছু মুক্তমনা-নাস্তিক নামধারী ব্লগার-ফেইসবুকার নিজের উদ্দেশ্যে নাস্তিকতা ব্যবহার করছেন, য্যামনটা করে ধর্মান্ধ ধার্মিকেরা। বয়সে ছোট অনেকে বন্ধুদের সামনে "ভাব" ধরার জন্য নাস্তিক সেজে বসে আছে, কেউ শ্রেফ বাহবা পেতে নাস্তিক হয়ে বসে আছে। ব্যবহার সহজ হওয়ায় ফেইসবুকেই তাদের বিচরণ বেশি। তাদের সম্পর্কে মোটামুটি সবারই ধারণা আছে। এতে করে ধার্মিকদের অতি-নেতিবাচক ধারণা হচ্ছে। তাদের ধারণা নাস্তিকতা কেবল জ্ঞানী সাজার জন্য, ভাব ধরার জন্য, স্রোতের বিপরীতে চলার জন্য, অন্য ধর্মের ছেলে-মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর জন্য।

তারা যা করছে তা কোনভাবেই নাস্তিকতা না, তারা কোনভাবেই মুক্তমনা না। তারা শ্রেফ ধর্ম-বিদ্বেষী। তারা ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কটুক্তি করছেন, ধর্মীয় মহাপুরুষদের অবমাননা করছেন, মক করেই যাচ্ছেন। নাস্তিকতার উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্ধবিশ্বাস দূর করা, অন্ধবিশ্বাস নিয়ে হাসি-তামাশা না। মুক্তমনা শুধু মুক্ত-মনের-অধিকারী না, মুক্তমনা হলো নিজে ধর্ম থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তিসঙ্গত চিন্তা করা, অন্যের যৌক্তিক মতামত মেনে নেয়া। তারা অন্যের যুক্তিসঙ্গত মতামত মেনে নেয়া তো দূরে থাক, তার নিজের মত না মানলে তার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছেন। মুক্তমনা নামধারী এসব নার্সিস্টিক পারসোনালিটি সম্পন্ন মানুষ মুক্তমতের বিপক্ষশক্তি, ধার্মিদের মধ্যে য্যামন ধর্মান্ধ থাকে। গত কয়েকমাস আগে সামহোয়্যারইন ব্লগে অনেক ঝামেলা হয়ে গ্যালো অ্যামন কিছু ব্লগারের কারণে। অন্যান্য ব্লগ কর্তৃপক্ষও অ্যাখন ধর্ম বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করছেন। এতে করে ধর্মের সমালোচনার পথও অনেকটা সংকুচিত হয়ে গ্যালো। অ্যামন "নাস্তিকতার চর্চা" অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে মনে মনে নাস্তিকতার চর্চা করতে হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এই মুক্তমনা-নাস্তিক দাবীদারদের কিছু উদাহারণ দেয়া যাক, তারা আল্লাহ-পাক কে বিকৃতভাবে বলছেন "আল্লাহ-নাপাক", "আল্লা-ফাক", "আল্ল্যাপাক" ইত্যাদি, মুহম্মদকে বলছেন "মহাউন্মাদ", "মহা-ম্যাড" ইত্যাদি। খোদা, নবিদের নিয়ে কার্টুন এঁকে যাচ্ছেন, বিভিন্ন পশুতে তাদের আকার দিচ্ছেন। আস্তিকেরাও কম যান না, তারা আরজ আলী মাতুব্বরকে বলছেন জারজ আলী, বার্ট্রন্ড রাসেলকে বাস্টার্ড রাসেল। এইসব করে তারা তাদের মতোন কিছু ধর্ম-বিদ্বেষী/ধর্মান্ধের বাহবা পাচ্ছেন, লাভের মধ্যে লাভ হচ্ছে ধার্মিকদের কয়েক ফোঁটা যে ধৈর্য্য ছিলো, তার বিচ্যুতি। নাস্তিকতার উদ্দেশ্য হাসিল তো হচ্ছেই না, উল্টো নাস্তিকদের সম্পর্কে সবার একটা বাজে ধারণা হচ্ছে। আপনিই বলেন, আপনার নাম বিকৃতভাবে বললে আপনাদের অনুভূতি ক্যামন হতো? আপনি তো কোন ধার্মিকের নাম বিকৃত করছেন না, আপনি বিকৃত করছেন অ্যামন এক অদৃশ্য সত্তার যার জন্য ধর্মান্ধ মানুষ বিনাশর্তে প্রাণত্যাগ করতে পারে। আপনি কী ধারণা করতে পারছেন না এর প্রতিক্রিয়াটা ক্যামন হবে? এইতো কিছুদিন আগেই অন্তর্জালে প্রকাশিত সামান্য একটা ছবি নিয়ে চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে গ্যালো, এটাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলা যায় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে, ক্যানোনা সেখানে কেবল এক ধর্মের অনুসারীরাই হামলা চালিয়েছিলো। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরো ঘটবে। ব্যাপারটা হয়তো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিলো, আস্তিক-নাস্তিক দ্বন্দ্ব ছিলো না, কিন্তু ঘটতে কতোক্ষণ? আমাদের বড়োমাপের যারা মুক্তমনা-নাস্তিক ছিলেন, তাদের মধ্যকার খুব বেশি মানুষ বেঁচে নেই। যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তাদের মৃত্যু হতো হুমায়ুন আজাদের মতো করে।

ধর্ম সময়ের পরিবর্তনে এমনিতেই মিলিয়ে যাবে, কিন্তু মুক্তমনা-নাস্তিক নামধারী ধর্ম-বিদ্বেষীদের সাম্প্রতিক কর্মকান্ড হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। এর রেষ বইতে হবে সত্যিকারের মুক্তমনাদের। আমার ধারণা কয়েক বছরের মধ্যে সত্যিকারের মুক্তমনা-নাস্তিকদের নামতে হবে এইসব ধর্মবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে। নার্সিস্টিক পারসোনালিটি সম্পন্ন ব্লগার-ফেইসবুকারগণ হিটের আশা বাদ দিয়ে সত্যিকারের নাস্তিকতার চর্চা করুন, তাতে নাস্তিকতার প্রসার দ্রুততর হবে। বিশ্বাস করুন, আপনারা প্রক্রিয়াটাকে আরো ধীর করে দিচ্ছেন।

আমাদের লক্ষ্য হোক অন্ধবিশ্বাস দূর করা, ধর্ম-বিদ্বেষ নয়।