কিং মিডাস - সোনালী স্পর্শ-শক্তির ও গাধার কান প্রাপ্ত এক বোকা রাজা

কিং মিডাস - সোনালী স্পর্শ-শক্তির ও গাধার কান প্রাপ্ত এক বোকা রাজা
কাফি রশিদ, ৩১/১০/১২


গোলাপের দেশ ফ্রিজিয়া’র রাজা মিডাস’কে সবচে বিত্তশালী কয়েকজনের একজন ধরা হয়, যদিও তিনি তার বেশিরভাগ ধনসম্পদ ভোগ করতে পেরেছিলেন একদিনেরও কম সময় ধরে। তিনি যতোটা বিত্তশালী ছিলেন, তারচে বেশি ছিলেন বোকা। তার বোকামি ছিলো মৃত্যুর মতো ভয়ানক, পাপের মতো মারাত্মক, তবে তা অন্যদের ক্ষতির কারণ ছিলো না কখনোই।

রাজা মিডাসের ছিলো বিশাল বিশাল গোলাপের বাগান সংযুক্ত এক প্রাসাদ। একদিন সেই বাগানের ভিতরে ইতঃস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন বৃদ্ধ সাইলেনাস – যিনি কিনা ডায়োনিসাসের (ব্যাক্কাস) আবাসস্থল থেকে বের হয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন। মিডাসের কিছু ভৃত্য গোলাপ বাগানের ভিতরে স্থুলকায় বৃদ্ধ সাইলেনাসকে মাতাল ও অর্ধঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে গোলাপের মালা দিয়ে বেঁধে ফেললো, মাথায় পরিয়ে দিলো ফুলডোর। এরপর সাইলেনাসকে ডেকে তুলে চরম কৌতুকের পাত্ররুপে নিয়ে গেলো মিডাসের কাছে। মিডাস তাকে চিনতে পেরে ভৃত্যদের বকাঝকা করে খুব আপ্যায়ন করলেন আর দশদিন পর তাকে ডায়োনিসাসের কাছে নিয়ে গ্যালেন। ডায়োনিসাস সাইলেনাসকে পেয়ে খুবই খুশি হলেন এবং মিডাসকে বললেন বর হিশেবে সে যা চাইবে তা দেয়া হবে। মিডাস কোনকিছু না ভেবেচিন্তে বললেন তিনি যা স্পর্শ করবেন তা-ই য্যানো স্বর্ণ হয়ে যায়। বর দানের আগেই ডায়োনিসাস বুঝতে পেরেছিলেন এর ফল খুব বেশি ভালো হবে না। তারপরেও তিনি অনুমোদন করলেন, মিডাস ফ্রিজিয়ায় ফিরে গেলেন।

ফ্রিজিয়ায় এসে যেই খাওয়ার জন্য খাবার হাতে নিলেন মিডাস, ওমনি তা স্বর্ণ হয়ে গ্যালো। বোকা রাজা খুশিতে বাগডুম হয়ে বাগানে গিয়ে একেরপর এক গোলাপ স্পর্শ করে স্বর্ণে পরিণত করতে লাগলেন। অ্যামন সময় তার মেয়ে বাগানে চলে আসলো। মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে তাকেই স্বর্ণের মূর্তিতে পরিণত করে ফেললেন। এরপর কেঁদেকেটে একাকার হয়ে ডায়োনিসাসের কাছে গ্যালেন। গিয়ে তাকে তার বর ফেরত নেয়ার জন্য করজোড়ে অনুরোধ করলেন। ডায়োনিসাস বললেন প্যাক্টোনাস নদীর উৎসে গিয়ে অবগাহন করতে, তাহলেই বর প্রত্যাহার হয়ে যাবে। মিডাস তা-ই করলেন, পরিবর্তে ফিরে পেলেন তার মেয়েকে। প্যাক্টোনাস নদীর তীরের বালুতে স্বর্ণ পাওয়ার পিছনে এটিই ছিলো কারণ।


মেয়েকে কোলে নিয়ে মিডাস

মিডাসের বোকামি এখানেই শেষ না। একবার এক বাঁশিবাদন প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছিলো অ্যাপোলো ও প্যান’র মধ্যে। প্যান বাঁশিতে চমৎকার সুর তুলতে পারতেন, কিন্তু অ্যাপোলো যখন তার সোনালী বীণায় সুর তুলতেন, তখন অলিম্পাস কিংবা মর্তে অ্যামন কোন সুর ছিলো না যা তার চাইতে মধুর হতো – শুধু মিউজদের সুর ছাড়া। দেবতা মলাস অ্যাপোলোকে বিজয়ী ঘোষণা করলেন, আর মিডাস, যে কিনা সুরবিদ্যায় মোটেই জ্ঞান রাখতেন না, তিনি বিজয়ী ঘোষণা করলেন প্যান-কে। একেতো সুরের বিন্দুমাত্র জানেন না, তারউপর ধারণাও করতে পারেননি অ্যাপোলো’র বিরুদ্ধে যাওয়াটা কতো বিপদজনক হতে পারে। অ্যাপোলো বললেন যে মিডাসের শ্রবণক্ষমতা অ্যাতোই নিম্নমানের যে তার কান পাল্টে দেয়া হবে। তাই তাকে দেয়া হলো গাধার কান।


অ্যাপোলো’র গান শুনছেন মিডাস

গাধার কান নিয়ে মিডাস ফ্রিজিয়ায় ফিরে এলেন, সাথে একটি টুপিও নিয়ে এলেন কান ঢেকে রাখার জন্য। মুহুর্তের জন্যও তিনি টুপি খুলতেন না পাছে কেও দেখে ফেলে তার গাধার কান, অ্যামনকি ঘুমানোর সময়ও টুপি পরে ঘুমাতেন। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেন শীতের জন্য টুপি পরে থাকেন - তখন ছিলো শীতকাল। কিন্তু যখন একদিন যখন চুল কাটতে তার ভৃত্য এলো, তখন তিনি ভৃত্যকে আগেই সতর্ক করে দিলেন তার কানের কথা য্যানো কেউ না জানে। ভৃত্য কথা দিয়ে চুল কেটে চলে গ্যালো। কিন্তু কিছুদিন পর ভৃত্যটির পেটে কথা থাকতে চাইলো না, পেটে ভুটভুট শব্দ করতো। ভৃত্যটি তাই এক মাঠে দিয়ে গর্ত করে সেখানে মুখ এনে বললো, “আমাদের রাজার গাধার কান”, এই বলে সে হালকা বোধ করলো। তারপর গর্ত মাটি দিয়ে ভরাট করে চলে আসলো। কিছুদিন পর বসন্ত চলে এলো। সেই মাঠে নল-খাগড়া-গাছ-পালা জন্মালো। এরপরের ঘটনা খুবই মর্মান্তিক, যখনই গাছপালা বাতাসে দুলে উঠতো, তখন পাতা নড়ার মৃদুশব্দের বদলে আওয়াজ তুলতো “আমাদের রাজার গাধার কান”, যা গাছপালার নিচের মাটিতে সমাধিস্থ করে গিয়েছিলো মিডাসের ভৃত্য। রাজ্যের সবাই সেই মাঠে গিয়ে রাজার গোপন কথা শুনে আসতো আর বিড়বিড় করতো “আমাদের রাজার গাধার কান” – অবশ্যই রাজার সামনে মিটমিট করে হাসতো।

চরিত্র পরিচিতি :

ডায়োনিসাস বা ব্যাক্কাসঃ ডায়োনিসাস ছিলেন জিউস ও থিবীয় রাজকুমারী সেমেলি’র পুত্র। একমাত্র ডায়োনিসাসই ছিলেন অলিম্পাসে বসবাসকারী একমাত্র পূর্নাঙ্গ দেবতা যার মাতা ছিলেন একজন মরণশীল মানুষ। অন্যান্য যেসব দেবচরিত্র পাওয়া যায় যাদের পিতা-মাতা’র একজন মানুষ ছিলেন, তারা ছিলেন ডেমি-গড। জিউসের প্রেমিকা সেমেলি ছিলো দুর্ভাগা দেবতা-স্ত্রীদের একজন। আমরা পরে কোন এক পোষ্টে ডায়োনিসাসের কাহিনী পড়বো।


সেট্যার

সাইলেনাস : সাইলেনাস ছিলেন সেট্যারদের প্রধান, ডায়োনিসাস সহচর ও প্যানের প্রধান। প্যানের মতো তারও পা ও কান ছিলো ছাগলের মতন। প্যানের সাথে তার পার্থক্য হলো তার ঘোড়ার মতন একটা লেজও ছিলো।
প্যান : প্যান কোন দেবতা ছিলেন না। প্যানের কান ছিলো ছাগলের মতন, পা ও ছিলো ছাগলের।
অ্যাপোলো : অ্যাপোলো ছিলেন সোনালী-বীণা-রূপালী-ধনুকের দেবতা, সত্য-দেবতা, আলোর দেবতা, নেকড়ে-দেবতা সহ আরো অনেক গুণ সম্পন্ন দেবতা।
মলাস : মলাস ছিলেন পর্বত-দেবতা।
মিউজ : মিউজগণ সংখ্যায় ছিলো নয়জন।

অ্যাপোলো, প্যান ও মিউজদের সম্পর্কে দেব-দেবীদের পরিচয় পর্বের প্রথম খন্ডেদ্বিতীয় খন্ডে জেনেছি।