যম ও যমুনার জন্ম এবং ছায়া সৃষ্টির উপাখ্যান

যম ও যমুনার জন্ম এবং ছায়া সৃষ্টির উপাখ্যান
কাফি রশিদ, ৩০/০৫/১৩

বিশ্বকর্মার মেয়ে সংজ্ঞার সাথে মহা ধুমধামে সূর্যের বিয়ে হয়ে গ্যালো। লজ্জাবতী নারী হলে কী হয়, অন্তত লোকচক্ষুর আড়ালে তো স্বামীর দিকে ডাগর চোখ মেলে তাকাতে হয়। কিন্তু স্বামী যে স্বয়ং সূর্য, তার দিকে তাকালেই যে চোখ বন্ধ হয়ে আসে! সূর্যের ইচ্ছা সংজ্ঞার সাথে বসে গল্প করবে, সংজ্ঞার লজ্জাবনত চোখ আর লাল হয়ে যাওয়া গাল দেখে হেসে লুটোপুটি খাবে। সূর্যের তাপে সংজ্ঞার গাল লাল হয় ঠিকই, লজ্জাবনত চোখের পরিবর্তে দ্যাখা যায় দু'চোখ একেবারেই মুদে আছে। চটে গিয়ে সংজ্ঞাকে অভিশাপ দিলেন সূর্য, তার গর্ভের সন্তানকে দেখে য্যানো দুনিয়ার সব মানুষ মুদ্রিতচক্ষু হয়। জন্ম হলো যমের। দেবসন্তান হলে কী হয়, যম সাম্যবাদের চর্চা করে। প্রাসাদ থেকে পর্ণকুটির, সবখানেই তার যাতায়াত, রাজা-প্রজা সকলেই তার দর্শনে চিরকালের জন্য মুদ্রিতচক্ষু হয়ে পরে। এই হলো আমাদের যম, বুড়ো হলে আমরা তার দর্শন এঁড়াতে তটস্থ হয়ে পড়ি। 

সংজ্ঞা মনেপ্রাণেচোখে চেষ্টা করেন স্বামীর দিকে তাকাতে, কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে সারাদিন তাপালো বিকিরণ করে দিনান্তে যখন সূর্যের বিশ্রামের সময় হয় তখন সংজ্ঞা চোখ মেলে তাকাতে পারেন, তাও পিটপিট করে, বেশিক্ষণ পিটপিট করে তাকিয়ে থাকলেও দু'চোখ বেয়ে জল ঝরে। সারাদিন পরিশ্রম করে যদি জলঝরা চোখ নিয়ে স্ত্রী হাজির হয় তাহলে কারই বা ভালো লাগে। ধৈর্য্য হারিয়ে সূর্য আবারও অভিশাপ দেন সংজ্ঞাকে, তার গর্ভের সন্তান য্যানো হয় বিলোলা নদীরূপিণী। জন্ম হলো তাদের একমাত্র কন্যা সন্তান যমুনা'র। যমুনা নদী হয়ে নিজে তো ভাসেই, বছরে একবার আশেপাশের সবাইকে নিয়ে ভেসে যায়।

এরইমধ্যে তাদের আরেক সন্তানের জন্ম হয়, মনু। সে সারাদিন পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দুনিয়া সম্পর্কে তার মনোভাব বড়ো উদাসী। একদিকে তিন স্বভাবের তিন সন্তানের যন্ত্রণা, অন্যদিকে মার্তণ্ড স্বামীর দোর্দণ্ড প্র-তাপ, বিরক্ত হয়ে সংজ্ঞা ভাবে কিছুদিনের জন্য বাবার বাড়ি বেড়িয়ে আসবেন। কিন্তু হাজার হলেও সে তো সংসারী নারী, তার অবর্তমানে তার সন্তানদের খাওয়াবে কে, স্বামীর সেবাযত্নই বা কে করবে। সমাধান খুঁজতে সে নিজেই অবিকল নিজের মতোন তনু নির্মাণ করলেন। একইরকম নাক, একইরকম চোখ, একইরকম দেহ, হাঁটাচলা, উঠবসা অবিকল এক। পারবেই তো, সে যে বাবা বিশ্বকর্মা'র যোগ্য সন্তান। তার নাম হলো ছায়াসংজ্ঞা, সংক্ষেপে ছায়া। সংজ্ঞার অবর্তমানে সে সূর্য, মনু, যমুনা ও যমের দ্যাখাশুনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। সেই থেকে আমরা আমাদের অবিকল রূপে সবসময়ের বিশ্বস্ত সঙ্গী হিশেবে ছায়াকে পেয়ে আসছি। 

সংজ্ঞা ছায়াকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন, মনু-যম-যমুনাকে মাতৃস্নেহে লালন করতে হবে, বাড়ির সবার প্রয়োজনের দিকে নজর রাখতে হবে, বাড়ি ফিরে সূর্য যা কিছু চায় তা কিছু চাওয়ামাত্র দিতে হবে। তবে কেউ য্যানো ঘূনাক্ষরেও জানতে না পারে সে যে সংজ্ঞার ছায়া। দায়িত্ব কঠিন হলেও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবে ভেবে ছায়া সব মেনে নিলেন। তবে শর্ত দিয়ে দিলেন, কেউ যদি তার উপর শারীরিক নির্যাতন চালায় তবে সে সব ফাঁস করে দেবে। মেনে নিয়ে সংজ্ঞা পিত্রালয়ে গমন করলেন। সেখানে বিশ্বকর্মার উচ্ছাস দ্যাখে কে! তবুও কোথায় য্যানো একটু না পাওয়ার আভাস। মেয়ে এসেছে, তার ছেলে-মেয়েরা আসবে, হইহল্লা করবে, কিন্তু তা আর হলো কই। এদিকে একা একা চলে আসায় পাড়া-প্রতিবেশীরাও কানাঘুষা করছে। বিশ্বকর্মা তাই বাধ্য হয়েই সংজ্ঞাকে বললেন স্বামীর বাড়িতে ফিরে যেতে, কোন একদিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে য্যানো বেড়াতে আসে। পিত্রালয় থেকে বেরিয়ে এলেও সংজ্ঞা স্বামীর বাড়িতে গ্যালেন না, সে বহুদূরে গিয়ে স্বামীর উগ্র তেজ নিবারণে তপস্যায় বসলেন। 

ওদিকে সংজ্ঞার হয়ে ছায়া সংসার বেশ মানিয়ে নিয়েছে। ইতিমধ্যে ছায়া ও সূর্যের দুই ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম হয়েছে। অ্যাতোদিন তো ভালোই ছিলো, নিজের ছেলে-মেয়ের জন্মের পর মনু-যম-যমুনার আদর কমে গ্যালো। কে ই বা নিজের সন্তানের চেয়ে অন্যের সন্তানকে আদর দেবে। মনু পড়াশুনায় ব্যস্ত, যমুনা ব্যস্ত খলখলিয়ে বেড়াতে, এই তারতম্যের ব্যাপারটা শুধু চোখে পড়ে যমের। ছেলেবেলা থেকেই যম পক্ষপাতবিরোধী, তাই সে এই তারতম্যের বিরোধিতা করে। একদিন ধৈর্য্য হারিয়ে ছায়াকে লাথি দিতে এগিয়ে গ্যালে ছায়া যমকে অভিশাপ দেন। সৎ মা ও পুত্রের মনোমালিন্যের কথা সূর্যের কানে গ্যালে সে দুজনকে ডেকে পাঠান। ছায়া সব খুলে বলে, আবার যমও ছায়ার পক্ষপাতিত্বের কথা জানায়। এ ক্যামন মা যে কিনা নিজের সন্তানকে অভিশাপ দেন? ব্যাপারটা ভাবতে বাধ্য করলো সূর্যকে। ভেবে চিন্তে আবারও ডেকে আনলেন দুজনকে, লক্ষ্য করলেন সে কিছু একটা লুকোতে চাইছে। সূর্য সত্য উন্মোচনে ছায়াকে শাপ দিতে উদ্যত হলে সত্য উন্মোচন হলো।

নিজের অমিত তেজকে ধিক্কার দিয়ে স্বশুরালয়ে ছুটলেন স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। কিন্তু শিষ্টাচার-প্রণামাদি পর্ব শেষে যখনই সংজ্ঞার কথা জিজ্ঞেস করলে বিশ্বকর্মা জানালেন সে অনেকদিন আগে চলে গেছে। বিশ্বকর্মা কন্যার জন্য বিচলিত হলেন, সূর্যের অবস্থাও তথৈবচ। ধ্যাননেত্রে সূর্য দেখলেন সংজ্ঞা স্বামীর তেজ কমানোর তপস্যার রত। নিজের ভুল বুঝতে পেরে সমস্ত দায় নিজের উপর চাপিয়ে নিলেন সূর্য। তপোভূমিতে মিলিত হলেন তপস্যারত সংজ্ঞার সাথে। বিশ্বকর্মাকে বলে নিজের তেজটাও কমিয়ে নিলেন। এরপর থেকে তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো। আর ছায়া? তাকে চিরকাল মানুষের জন্য অপ্রয়োজনীয় বলে অভিশাপ দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হলো।