কে কেনে মূলধারার সাংবাদমাধ্যমের ক্রয়যোগ্য মায়াকান্না?

কে কেনে মূলধারার সাংবাদমাধ্যমের ক্রয়যোগ্য মায়াকান্না?

কাফি রশিদ, ১৬/০১/১৩

“আসিফ মহিউদ্দীনের উপর হামলার ঘটনা মেইনস্ট্রীম মিডিয়ায় বিন্দুমাত্র প্রায়োরিটি না পাওয়ায় এই কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি যে মালালা’র উপর হামলার খবর ফলাও করে প্রচার করতে প্রতিটি প্রিন্ট-ইলেক্ট্রিক মিডিয়া আইএসআই’র টাকা খেয়েছিলো। মেইনস্ট্রীম মিডিয়া’য় আমার বিশ্বাস কখনোই ছিলো না, এখন প্রচন্ড অবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে।” – এটা শুধু আমার নিজের না, আমার মতোন আরো হাজারো ব্লগার-ফেইসবুকারের কথা। আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে চলেছি এই দেশের বড়ো বড়ো পত্রিকাওয়ালারা-টিভি চ্যানেলওয়ালারা টাকা খেয়ে বিশেষ এজেন্ডা নিয়ে রঙ-বেরঙের সংবাদ ছাপায়, দ্যাখায়।

ঘটনা ১: ব্লগার মালালা ইউসুফজাই, পাকিস্তানি কিশোরী, বয়স পনের। লেখালেখি করেন বিবিসি’র উর্দূ ইউনিটে। ব্লগিং’র বিষয় পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় নারী শিক্ষা ও এর উপর তালেবান’র প্রভাব। গত ৯ অক্টোবর স্কুল বাসে করে বাসায় ফেরার পথে কয়েকজন তালেবানি তার উপর হামলা চালায়, গুলিবিদ্ধ হন মালালা। এরপরে যা ঘটেছে আমরা সবাই জানি। সভ্য দেশের নাগরিক হিশেবে আমরা এই হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছি, ঘৃণায় থুথু ফেলেছি বর্বর পাকিস্তানিদের কথা চিন্তা করে। আমরা দেখেছি সেই দেশটাতে মতপ্রকাশ করা কতো কঠিন, একজন ব্লগারের লেখালেখি মৌলবাদীদের মনপূত না হলে গুলি খেয়ে মরে যেতে হয়। শুধু পনের বছর বয়সী কিশোরী মালালা নন, একজন ব্লগার মালালা’র মতপ্রকাশের অধিকারের জন্যও আমরা কথা বলেছি। দেশের সবকয়টি সংবাদপত্র মালালাকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন ছেপেছে, মালালা বেঁচে রইলেন নাকি মরে গ্যালেন সেই খবর প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপিয়ে আমার চোখের সামনে এনে ফেলেছে, সব কয়টি টিভি চ্যানেল মালালার উপর নির্মিত ভিডিও ফুটেজ দেখিয়েছে, টক শো হয়েছে, সুশীল সমাজের সুশীলেরা মালালাকে নিয়ে, মালালার মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। মালালা যেদিন সুস্থ হয়ে দেশে ফিরলেন সেদিনকার খবরও ফলাও করে ছেপেছে কয়েকটি দৈনিক।

ঘটনা ২: আসিফ মহিউদ্দীন, বাংলাদেশি যুবক। লেখালেখি করেন বেশ কয়েকটি কমিউনিটি ব্লগে। ব্লগিং’র বিষয় ধর্মীয় গোড়ামি, যুদ্ধাপরাধ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। শুধু লেখালেখিই না, একজন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট হিশেবেও সমান পরিচিত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ধিত বেতন-ফী’র বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, একবার ডিবি ধরে নিয়ে গিয়েছিলো তাকে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে তিনি একজন “বিশৃংখলাকারী ব্লগার”। ধর্ম নিয়ে লেখালেখির কারণে প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীদের শত্রু, যুদ্ধাপরাধ নিয়ে লেখালেখির কারণে জামায়াত-শিবির সমর্থকদের শত্রু। গত ১৪ জানুয়ারী উত্তরা’র কর্মস্থল থেকে বের হয়ে আসলে মুখ ঢাকা তিন দুর্বৃত্ত আসিফ মহিউদ্দীনকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। বুক, পিঠ, কোমর ও গলায় সাতটি আঘাত করা হয়, যার মধ্যে গলার দুটি কোপ ছিলো মারাত্মক। প্রথমে উত্তরার একটি হাসপাতালে নেয়া হলেও সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ট্রান্সফার করেন। দীর্ঘ চার ঘন্টার অপারেশনে বেঁচে যান তিনি।

উপরের দুইজনই ব্লগার, দুইজনের উপরেই হামলা চালিয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীরা। তবে প্রথমজনকে নিয়ে ব্যপক হৈচৈ হলেও দ্বিতীয়জনের কথা কয়েকটি কমিউনিটি ব্লগের ব্লগার ও কিছু ফেইসবুকাররা ছাড়া কেউ জানেননা। কারণ ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনের উপর মৌলবাদীদের হামলা নিয়ে কয়েকটি অনলাইন সংবাদপত্র ছাড়া কেউ সংবাদ ছাপেনি, টিভিতে দ্যাখায়নি। মালালা’র খবর যদি না ছাপা হতো, যদি টিভি চ্যানেলে দ্যাখানো না হতো, তাহলে বিশ্বাস করতাম ব্লগের নীল রঙের নিকের আড়ালে যে একজন রক্তমাংশের মানুষ আছেন, এই কথাটা হয়তো কাগুজে সংবাদপত্র-অলারা আর চ্যানেল-অলারা জানেনা না। কিন্তু এই কথা বিশ্বাস করে নিজেকে বোঝানোর উপায় নেই। স্যুটেড-বুটেড সুশীলেরা, যারা মালালা প্রসঙ্গে মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে কুঁইকুঁই করেছিলেন, বড়ো বড়ো সংবাদপত্র-অলা যারা চার রঙা সচিত্র প্রতিবেদন ছেপেছিলেন, টিভি চ্যানেল-অলা যারা মালালাকে বহনকারী গাড়িটা পর্যন্ত আমাদের দেখিয়েছিলেন, তারা এখন দেশের একজন ব্লগারের উপর মৌলবাদীদের হামলার সময় কোথায় লুকিয়ে রইলেন? আমরা ব্লগাররা, অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা চাঁদা তুলে আপনাদের হাতে তুলে দিবো আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে?

আমার প্রচন্ড হাসি পায় যখন দেখি আমাদের বদলে দেয়ার কথা বলে, আমাদের কাছে সত্য সংবাদ পৌছে দেয়ার কথা বলে, “নির্ভিক” কিছু সাংবাদিক-সম্পাদক আমাদেরকে তাদের মনগড়া ঘেউঘেউ শুনাচ্ছেন। পাকি-মলে মাথা ঢুকিয়ে আমাদের পশ্চাতদেশ দ্যাখানো এদের কষে এক লাথি মারার ইচ্ছা খুব কষ্টে দমিয়ে রাখছি।

(প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে লেখা। অনলাইন নিউজপেপারগুলো ছাড়া একজন ব্লগারের উপর মৌলবাদীদের হামলা সম্পর্কে কোন সংবাদপত্র লিখলো না। হতাশাজনক।)