রুশ উপকথা : গপ্পী বৌ

রুশ উপকথা : গপ্পী বৌ
কাফি রশিদ, ১৪/৯/২০১১

অনেকদিন আগে এক গাঁয়ে ছিলো এক চাষী। আর ছিলো চাষীর বৌ। বৌ টা সারাদিন বকবক করে যেত, ভারী গপ্পী ছিলো বৌ টা, কোন কথা পেটে রাখতো না। তার কানে কোন কথা পৌঁছলেই সেটা সারা গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়তো।
একদিন চাষী বনে গেলো। বনের মধ্যে নেকড়ে ধরার গর্ত খুড়তে গিয়ে হঠাত গুপ্তধন পেয়ে গেলো। চাষী ভাবল, ‘এখন কি করি? আমার বৌ তো গুপ্তধনের কথা শুনলেই সারা পাড়ায় রটিয়ে দিবে। জমিদারের কানে কথাটা যাবে, ব্যস, টাকা ও আর পেতে হবে না। জমিদারই সবটা গায়েব করে দিবে।’
ভাবতে ভাবতে একটা বুদ্ধি এলো চাষীর মাথায়। গুপ্তধনটা আবার মাটিতে পুঁতে রেখে জায়গাটা চিহ্ন দিয়ে ফিরে গেলো। নদীর কাছে আসতে জলের দিকে তাকিয়ে দেখে জালের মধ্যে মাছ ছটফট করছে। মাছটা বের করে নিয়ে চাষী আবার চলল। একটু পরেই তারই পাতা ফাঁদের কাছে এসে দেখে একটা খরগোশ তাতে আটকা পড়েছে।
চাষী খরগোশটা বের করে নিয়ে সেখানে মাছটা রাখলো আর খরগোশটা জরালো জালের মধ্যে।
চাষী বাড়ি ফিরলো বেশ রাত করে। বাড়ি ফিরে বউকে বললো, ‘কিছু পিঠা বানাও তো তাতিয়ানা।’
‘সে কি? সন্ধ্যার পর কেউ কখনো উনুন ধরায় নাকি? এতো রাতে কেই বা আবার পিঠা তৈরী করে? শখ দেখো বুড়োর!’
ধমক দিয়ে চাষী বলল, ‘যা বলছি করো, গুপ্তধন পেয়েছি আমি। আজ রাতেই বাড়ি নিয়ে আসবো।’
চাষীর বৌয়ের তো আর খুশিতে ধরে না। তাড়াতাড়ি উনুন ধরিয়ে পিঠা বানাতে বসে গেলো। বলল, ‘গরম গরম খাও গো!’
চাষী একটা করে খায় আর বৌয়ের অজান্তে দুইটা করে থলিতে পুরে। আবার একটা খায়, আরো দুইটা থলেতে ঢুকায়। বৌ বলল, ‘আজ দেখি তুমি গোগ্রাসে গিলছো, আমি যে ভেজে উঠতেই পারছি না।’
‘বহুদুর যেতে হবে গো, গুপ্তধনটাও খুব ভারি, তাই পেট পুরে খেয়ে নিচ্ছি।’ ‘আমার পেট ভরেছে, তাড়াতাড়ি তুমি কিছু খেয়ে নাও। তারপর চলো বেরিয়ে পরি’ বলল চাষী।
খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলো বৌ, তারপর দুইজন বেরিয়ে গেলো গুপ্তধন আনতে। ততক্ষনে বেশ রাত হয়ে গেছে। চাষী আগে আগে যায় আর একটা করে পিঠা গাছে ঝুলিয়ে রাখে। সেগুলো চোখে পরে বৌয়ের, বলে ‘দেখো দেখো, গাছে পিঠা ধরেছে।’
চাষী বলে, ‘এ আর এমন কি! একটু আগে দেখলে না পিঠা বৃষ্টি হয়েছে।’
‘আমি তো মাতিতে চোখ রেখে হাটছিলাম, যেনো গাছের শিকড়ে পা বেধে হুমড়ি না খেয়ে পরি’ বৌ বলল।
‘এইখানে একটা খরগোশ ধরা ফাঁদ রেখেছিলাম, চলো দেখি কি ধরা পড়লো’ চাষী বলে। ফাঁদের কাছে এসে মাছ বের করে চাষী, তা দেখে বৌ বলে, ‘ও মা! জলের মাছ ডাঙ্গায় এলো কি করে!’। অবাক হওয়ার ভান করে চাষী, বলে উঠে, ‘এ আর এমন কি! জলের মাছ যেমন আছে, ডাঙ্গার মাছও আছে।’
আরো খানিকদূর যাওয়ার পর বৌ বলল, ‘এখানে না তোমার জাল ফেলা আছে? চলো দেখি কিছু পাওয়া গেলো কিনা’, ওরা যেই জাল টেনে তুললো, দেখে একটা খরগোশ। সাঙ্ঘাতিক অবাক হয় বৌ। ‘মা গো! আজ হচ্ছে কি এসব? ডাঙ্গার খরগোশ ধরা পড়লো মাছ ধরা জালে’, বিরক্ত হওয়ার অভিনয় করে চাষী, ধমক দিয়ে বলে, ‘আরে মূর্খ। জল-খরগোশও দেখোনি কখনো?’
‘সত্যি দেখিনি’, বৌ বলল।
একসময় গুপ্তধন পোঁতা জায়গায় পৌছোয় চাষী আর তার বৌ। গুপ্তধন বস্তায় ভরে নিয়ে বাড়ির পথ ধরে দু’জন।
হাটতে হাটতে একসময় জমিদার বাড়ির আস্তাবলের কাছাকাছি যায় ওরা।
গরু-ছাগল-ঘোড়া’র ডাক একসাথে শুনে ভয় পেয়ে যায় বৌ, ‘ও বাবা! ওটা কি গো, ভীষন ভয় করছে আমার।’
‘ওটা ভূত, জমিদার বাবুকে গলা টিপে মারছে। জলদি চলো।’ তাগাদা দেয় চাষী।
বাড়িতে গিয়ে গুপ্তধনের বস্তা লুকিয়ে শুয়ে পরে ওরা। সকালে বের হওয়ার আগে চাষী বৌকে বলে, ‘গুপ্তধনের কথা আবার কাউকে বলো না তাতিয়ানা। তাহলো বড় বিপদে পরে যাবো।’
‘কি যে বলো, ঘূর্নাক্ষরেও কাউকে বলবো না’, বৌ বলে চাষীকে।
কাজে বেরিয়ে যায় চাষী, আর বৌ যায় পানি আনতে। পাশের বাড়ির বৌ জিজ্ঞেস করে চাষীর বৌকে, ‘আজ এতো দেরি কেন গো?’, ‘ আর বলবেন না, গুপ্তধন আনতে আনতে এতো ক্লান্ত হয়ে পরেছিলাম যে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলো।’
পরদিন সারা গাঁয়ে ছড়িয়ে পরলো চাষী আর তার বৌ দুই বস্তা গুপ্তধন পেয়েছে। একান ওকান করে সেই কথা গিয়ে পৌছালো জমিদার বাবুর কাছে। তলব করলো চাষী আর তার বৌকে।
‘গুপ্তধন পেয়েছো আমাকে জানাওনি কেনো?’ জিজ্ঞেস করে জমিদার।
‘গুপ্তধন? জীবনেও শুনিনি বাবু। আমি গুপ্তধন পাবো কোত্থেকে!’, চাষী বলে।
‘বাজে কথা রাখো, তোমার বৌ ই ছড়িয়েছে এই কথা।’
‘ওর কথা বিশ্বাস করবেন না বাবু, ওর মাথার ঠিক নেই’
‘আচ্ছা দাড়াও পরখ করে দেখছি’, এই কথা বলে জমিদার মাথা ঘোরায় চাষী বৌয়ের দিকে, জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি আর তোমার স্বামী গুপ্তধন পেয়েছো?’
‘আজ্ঞে হ্যা বাবু’, উত্তর দেয় বৌ।
‘তারপর তুমি আর তোমার স্বামি সেগুলো বস্তায় করে বাড়িতে এনেছো?’
‘হ্যা জমিদার বাবু।’
‘কিভাবে কি হলো খুলে বলোতো দেখি।’ জানতে চায় জমিদার বাবু।
‘ও এসে আমাকে বলে গুপ্তধন পেয়েছে, আমি তো বিশ্বাস ই করতে চাইনি। এরপর আমরা খাওয়াদাওয়া করে গুপ্তধন আনতে বের হই। কিছুদুর যাওয়ার পর দেখি গাছে পিঠা ধরেছে।’
‘গাছে পিঠা ধরেছে মানে? গাছে পিঠা ধরে কিভাবে?’ জমিদার জিজ্ঞেস করে।
‘না মানে অল্প কিছুক্ষন আগে পিঠা বৃষ্টি হয়েছিলো কিনা, সেগুলো গাছে আটকে ছিলো। এরপর আমরা আরো কিছুদুর যাওয়ার পর দেখলাম আমাদের খরগোশ ধরা ফাদে একটা ডাঙ্গার মাছ ধরা পড়েছে। মাছটা তুলে নিয়ে নদীর ধার ধরে যাচ্ছিলাম, জাল তুলে দেখি একটা জল-খরগোশ ধরা পড়েছে। সেটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যখন গুপ্তধন নিয়ে বাড়িতে আসছিলাম, তখন দেখতে পেলাম আপনাকে ভুত গলা টিপে মারতে চাইছে। ভয় পেয়ে আমরা তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসলাম।’ এক নাগাড়ে বলে যার বৌ।
এইকথা শুনে রেগে গিয়ে মাটিতে পা ঠুকে জমিদার বাবু। চীৎকার করে বলল, ‘বেড়িয়ে যাও হাঁদা মেয়ে কোথাকার।’
‘দেখলেন তো বাবু, ওর মাথার ঠিক নেই। ওর কোন কথাই বিশ্বাস করা যায়না। সারাটা জীবন এভাবেই অশান্তিতে কাটাচ্ছি ওকে নিয়ে।’ চাষী দুঃখ করে বলে।
‘বুঝতে পেরেছি, নিয়ে যাও ওকে’ জমিদার বলল।
বাড়ি চলে গেলো চাষী। আর গুপ্তধনের অর্থে সুখে-স্বাচ্ছন্দে দিন কাটাতে লাগলো। এখনো বেঁচে আছে চাষী, থুড়থুড়ে বুড়ো হয়ে গেছে তাই আর মাছ-নেকড়ে কিংবা খরগোশ ধরতে বেরোয় না। সারাদিন শুয়ে থাকে আর জমিদার বাবুর কথা ভেবে হেসে গড়াগড়ি খায়।