গ্রীক বীর হারকিউলিসের অ-বীরোচিত কিছু কর্ম ও অকাল প্রয়াণ

গ্রীক বীর হারকিউলিসের অ-বীরোচিত কিছু কর্ম ও অকাল প্রয়াণ
কাফি রশিদ, ০৯/১১/১২

অসম্ভব শক্তিশালী ও প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী হারকিউলিসের বুদ্ধিমত্তা প্রায়শই তার শক্তির মতোন প্রকাশ পেত না, তাই তার অনেক কাজই ছিলো ভয়ানক দৃষ্টিকটু। আসাধারণ শক্তির কারণে তিনি নিজেকে দেবতাদের সমতূল্য ভাবতেন, একারণে অনেকবার তাকে বিভিন্ন কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছে। দেব-দেবীদের অতিপ্রাকৃত শক্তি ছাড়া অন্য কোন শক্তির কাছে তিনি পরাজিত হননি। নিজেকে দেবতাতূল্য ভাবারও কারণ আছে, একসময় দেবতারা জায়ান্টদের পরাজিত করতে তার সাহায্য নিয়েছিলেন। একদা ডেলফির মন্দিরে পুরোহিতগণ যেই ত্রিপদী আসনের উপর বসতেন সেই আসন কেড়ে নিয়ে নিজেই ভবিষ্যদ্বাণী করবেন বলে অ্যাপোলোর সাথে প্রায় লড়াইয়ে উপনীত হয়েছিলেন, অবশ্যই জিউসের মধ্যস্থতায় সেটার সমাপ্তি ঘটে। আবার একদিন প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে সূর্যের দিকে ধনুক তাক করে সূর্যকে তীরবিদ্ধ করার হুমকি দেন। আবার একদিন সমুদ্রের ঢেউয়ে তার নৌকা উল্টে যাওয়ায় সমুদ্রকে বলেন যে যদি কিছুক্ষণের মধ্যে সমুদ্র শান্ত না হয় তাহলে সমুদ্রকে শায়েস্তা করবেন। এভাবে প্রায়ই তিনি নিজেকে দৃষ্টিকটুভাবে অন্যদের কাছে উপস্থাপন করেছেন। 

রাজকুমারী ডেয়ানাইরা

“হারকিউলিসের ১২টি শ্রম” পূর্ন করে হারকিউলিস ডেয়ানাইরা নামক এক রাজকুমারী’র প্রেমে পরেন। নদী-দেবতা একিলিসও ডেয়ানাইরাকে ভালোবাসতেন। এই নিয়ে তাদের দুইজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব দ্যাখা দেয়। একিলিসের কোন ইচ্ছা ছিলো না হারকিউলিসের সাথে লড়াইয়ে জড়ানোর, তিনি চাইছিলেন যুক্তির মাধ্যমে হারকিউলিসকে বশে আনতে। কিন্তু তার প্রস্তাব গোঁয়ার হারকিউলিসকে আরো ক্রুব্ধ করেছিলো। একসময় একিলিস রাজি হয়ে এক ষাঁড়ের রুপ ধারণ করেন এবং প্রচণ্ডভাবে হারকিউলিসকে আঘাত করেন। এদিকে হারকিউলিস ছিলেন ষাঁড়বশীকরণে দক্ষ। প্রচণ্ড লড়াইয়ে হারকিউলিস একিলিসের একটি শিং ভেঙ্গে বিজয়ী হলেন। আর যার জন্য এতো লড়াই, সেই ডেয়ানাইরা হারকিউলিসের স্ত্রী হলেন। 

ট্রয়ে তিনি এক তরুণীকে রক্ষা করেন য্যামনটা করেছিলেন পার্সিউস অ্যান্ড্রোমিডাকে রক্ষা করে। তরুণীটি ছিলেন লাওমিডাসের কন্যা। একদা লাওমিডাস জিউসের নির্দেশে অ্যাপোলো ও পোসেইডনের জন্য ট্রয়ে এক বিশাল প্রাচীর নির্মান করেছিলেন। পরবর্তীতে লাওমিডাস পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে তাদের সাথে প্রতারণা করলে অ্যাপোলো শাস্তিস্বরূপ ট্রয়ে প্লেগ জাতীয় রোগের মহামারি পাঠান, আর পোসেইডন লাওমিডাসের কন্যা হরণ করতে পাঠান এক সামুদ্রিক দানব। হারকিউলিস লাওমিডাস কন্যাকে উদ্ধার করতে সম্মত হলেন, শর্ত ছিলো লাওমিডাস জিউসের থেকে পারিশ্রমিক হিশেবে যতগুলো ঘোড়া নিয়েছিলেন তা ফেরত দেবে। কিন্তু উদ্ধার শেষে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় হারকিউলিস তার কন্যাকে নিয়ে যান। এরপর তাকে তুলে দেন তার বন্ধু সালামিসের টেলামনের হাতে। 

প্রমিথিউসকে উদ্ধার করছেন হারকিউলিস

স্বর্ণ আপেল বিষয়ে হারকিউলিসের বারোটি শ্রমের যে একটি শ্রম ছিলো, তা সম্পন্ন করার জন্য অ্যাটলাসের কাছে যাওয়ার আগে হারকিউলিস ককেশাশে চলে যান। সেখানে গিয়ে রক্ষা করেন প্রমিথিউসকে। যিনি মানুষকে আগুন উপহার দেয়ার অপরাধে জিউস কর্তৃক এক পর্বতের চূড়ায় বাঁধা অবস্থায় এক ঈগল দ্বারা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলেন। 
এইসব বীরত্বপূর্ন কাজের সাথে অনেক অমর্যাদাকর কাজও করেন হারকিউলিস। একবার এক ভোজের আগে এক বালক দূর্ঘটনাবশত তার হাতে পানি ঢেলে দেয়। রাগে তিনি বালকটিকে ঘুষি মারলে বালকটির সেখানেই মৃত্যু হয়। বালকটির পিতা হারকিউলিসকে ক্ষমা করলেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারেননি। তাই তিনি কিছুদিনের জন্য দেশান্তরী হয়ে যান। 

এরপর গ্রীসে ফিরে তিনি বিনাকারণে হত্যা করেন এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। অভিযোগঃ বন্ধুটির পিতা রাজা ইউরিটাস হারকিউলিসকে কোন একসময় অপমান করেছিলেন। এই বিনাকারণে হত্যায় জিউস নিজে হারকিউলিসকে শাস্তি প্রদান করেন। তিনি হারকিউলিসকে তিন বছরের জন্য পাঠিয়ে দেন লিডিয়া’তে রানী ওমফেলের ক্রীতদাস হিশেবে। সেখানে রানী তার সাথে মজা করতেন। কখনো নারীদের পোষাক পড়িয়ে, কখনো নারীসুলভ কাজকর্ম করিয়ে। রানীর কাছে তিনি ধৈর্য্যর সাথে নিজেকে সমর্পন করলেও এর জন্য আবারো রাজা ইউরিটাসকে দায়ী করেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন মুক্তি পেলে ইউরিটাসকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেবেন। 

নারীদের পোষাকে হারকিউলিস

হাস্যরসে মগ্ন হারকিউলিস, ওমফেলের প্রাসাদে

ডায়োমিডাসের নরখাদক ঘোড়া সংশ্লিষ্ট যে একটি হারকিউলিসের শ্রমের অভিযান ছিলো, সেই অভিযানের সময় একটি ঘটনা ঘটে। ঘোড়াগুলোকে আনার জন্য রওনার পর তিনি তার বন্ধু অ্যাডমিটাসের বাড়িতে এক রাত কাটানোর পরিকল্পনা করেন। তিনি যখন অ্যাডমিটাসের বাড়িতে পৌছালেন তখন অ্যাডমিটাস ছিলো শোকাগ্রস্ত, কারণ কিছুক্ষণ আগেই তার স্ত্রী অ্যালসেস্টিস এক উদ্ভট কারণে মৃত্যুবরণ করেন। কারণটা ছিলো এরকমঃ

অ্যাপোলো’র পুত্র এসক্লেপিয়াস জিউসের বজ্রাঘাতে মৃত্যুবরণ করলে অ্যাপোলো জিউসের বজ্রবাহক সাইক্লোপসদের দোষী করেন ও তাদের হত্যা করেন। শাস্তি হিশেবে জিউস অ্যাপোলোকে একবছরের জন্য ক্রীতদাসরূপে মর্তে পাঠিয়ে দেন। অ্যাপোলো’র মনিব ছিলেন অ্যাডমিটাস। ক্রীতদাস হিশেবে থাকাকালীন তিনি অ্যাডমিটাস ও তার স্ত্রী অ্যালসেস্টিসের সাথে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন। একদিন বন্ধু অ্যাপোলো মারফত অ্যাডমিটাস জানতে পারেন যে নিয়তি-দেবীরা তার জীবনসূতা প্রায় বুনে এনেছে, কিছুদিনের মধ্যেই তা কাটা হবে। তবে কেউ যদি অ্যাডমিটাসের পরিবর্তে নিজের জীবন বিসর্জন দেয় তাহলে সে আরো কিছুদিন বাঁচতে পারবে। অ্যাডমিটাস ভেবেছিলেন তার জীবনকে অনেকে মূল্যবান মনে করে, কেউ না কেউ অবশ্যই তার জীবন বিসর্জন দেবে। কিন্তু তার বৃদ্ধ পিতা-মাতা, বন্ধু, কেউই নিজেদের জীবন উতসর্গ করতে রাজি না হলে অ্যালসেস্টিস নিজের জীবন বিসর্জন দিতে রাজি হন। অ্যালসেস্টিস যখন মারা গেলেন তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন অ্যাডমিটাস, এবং ঘোষণা করলেন চমৎকারভাবে আয়োজিত হবে তার স্ত্রী’র শেষকৃত্যানুষ্ঠান। অ্যামন সময় সেখানে উপস্থিত হন হারকিউলিস। বন্ধুর আগমন বার্তা পেয়ে অ্যাডমিটাস আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন তাকে কিছুই জানাবেন না। তারপরও হারকিউলিস ঘটনার কিছুটা আন্দাজ করতে পারায় তাকে জানান এক আগন্তুক নারীর মৃত্যু হয়েছে। এরপর হারকিউলিসকে কিছু ভৃত্য সহযোগে দূরের এক কামরায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে হারকিউলিস সারারাত মদ্যপান করে একসময় ভৃত্যদের কাছ থেকে আসল সংবাদ জেনে নেন। তারপর প্রতিজ্ঞা করেন অ্যালসেস্টিসকে মৃত্যু-দেবতা’র কাছ থেকে যেকোন মূল্যে ফেরত আনবেন। মৃত্যু-দেবতাকে তিনি কুস্তি খেলার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিজয়ী হলেন এবং অ্যালসেস্টিসকে ফিরিয়ে আনলেন হেডিস থেকে।

অ্যালসেস্টিসকে ফিরিয়ে আনার পথে হারকিউলিস

রানী ওমফেলের ক্রীতদাস থাকাকালে হারকিউলিস রাজা ইউরিটাসকে হত্যার যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সেই প্রতিজ্ঞা পূরণের লক্ষ্যে মুক্তির পরপরই একদল সৈন্য জোগাড় করে রাজার নগরী আক্রমণ করে নগরী দখল করলেন। তখনই প্রতিশোধ নেয়া হয়ে গিয়েছিলো, কারণ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজা ইউরিটাস এমনিতেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। নগরী ধ্বংস করার আগে তিনি একদল কুমারীকে তার স্ত্রী ডেয়ানাইরা’র পাঠান। এই কুমারী দলের মধ্যে অসাধারণ রূপবতী রাজকুমারী আয়োলি ছিলেন। যে লোকটিকে দিয়ে তাদেরকে পাঠানো হয়েছিলো সেই লোকটি ডেয়ানাইরা-কে বললো হারকিউলিস আয়োলি’র প্রেমে পরেছেন। এই খবরে ডেয়ানাইরা স্বভাবতই ক্রুব্ধ হলেন। তিনি সেই লোকটির মাধ্যমে একটি বিশেষ গাউন পাঠালেন হারকিউলিসের জন্য। বিশেষ গাউনটি ডেয়ানাইরা পেয়েছিলেন সেন্টর নেসাস’র কাছ থেকে। একদিন হারকিউলিসের সাথে নদী পারাপারকালে সেন্টর নেসাস ডেয়ানাইরাকে পিঠে তুলে মাঝ নদীতে নিয়ে লাঞ্ছিত করেন। তীরে পৌছে হারকিউলিসে’র আঘাতে নেসাসের মৃত্যু ঘটলে মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে গোপনে তিনি ডেয়ানাইরাকে বলেন তার রক্ত সংরক্ষণ করে রাখতে, হারকিউলিস যদি কখনো তার অবাধ্য হয় তাহলে সেই রক্ত কাজে দিবে। ডেয়ানাইরা তখন রক্ত সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। হারকিউলিসের জন্য পাঠানো গাউনটাতে সেই রক্ত মাখানো ছিলো। 

নেসাসকে হত্যা করছেন হারকিউলিস

যখন হারকিউলিস সেই গাউন পরিধান করলেন তখন তার শরীরে আগুনে পোড়ানোর মতোন যন্ত্রণা অনুভব করলেন। যন্ত্রণায় ক্ষিপ্ত হয়ে যার দ্বারা গাউন পাঠানো হয়েছিলো তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে হত্যা করলেন। এদিকে ডেয়ানাইরা জেনে গিয়েছিলেন হারকিউলিসের ভাগ্যে কি ঘটছে। ডেয়ানাইরা তখন আত্মহত্যা করলে হারকিউলিসও আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। সেই লক্ষ্যে ওয়েটা পর্বতের চূড়ায় এক চিতা তৈরী করেন ও তার উপর শুয়ে পরেন। তিনি তার অনুগত এক তরুণ ফিলোকটেসিসকে তার ব্যবহার্য্য তীর-ধনুক দান করেন, যেগুলো পরবর্তীতে ট্রয়ের যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলো এবং আদেশ দেন চিতায় আগুন ধরিয়ে দিতে। জ্বলে উঠলো অগ্নিশিখা। মৃত্যুর পর হারকিউলিসকে নিয়ে যাওয়া হলো স্বর্গে, সেখানে হেরা’র সাথে তার পুনর্মিলন ঘটলো এবং তার বিয়ে দেয়া হলো হেরা’র কন্যা হিবি’র সাথে। বলা হয় আকাশের সন্ধ্যা তাঁরায় হারকিউলিসের প্রতিকৃতি দ্যাখা যায়।

ছবি : উইকিপিডিয়া