পৌরাণিক গ্রীক দেব-দেবীগণ - প্রথম পর্ব

পৌরাণিক গ্রীক দেব-দেবীগণ - প্রথম পর্ব
কাফি রশিদ, ২৯/১০/১২

প্রথম পর্বে কয়েক টাইটান আদি দেব-দেবী ও বারোজন শ্রেষ্ঠ অলিম্পিয়ান দেব-দেবীদের পরিচয় দেয়া হলো। পরের পর্বে থাকছে মর্ত-সমুদ্র-পাতালপুরী'র বাকি সব দেব-দেবীদের পরিচয়।

আদি টাইটান দেব-দেবী :

অজানাকাল ধরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শাসনকর্তা ছিলেন বিশাল বপু ও অবিশ্বাস্য শক্তিধর টাইটানেরা। তারা সংখ্যায় অনেক হলেও সবার নাম জানা যায়না। কয়েকজনের বর্ননা পাওয়া যায় গ্রীক পুরাণ রচয়িতাদের কাব্য থেকে। তাদের মধ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ন ছিলেন “ক্রোনাস”, ল্যাটিন ভাষায় যিনি “স্যাটার্ন” নামে পরিচিত। নিজ পুত্র জিউসের হাতে পরাজিত হওয়ার আগপর্যন্ত টাইটানদের শাসন করেছেন তিনি। সেইসব টাইটান ছিলো ক্রোনাসেরই ভাই-বোন, গায়া’র সন্তান। রোমানদের মতে, যখন দেবতা রাজ জিউস আক্রমণ করলেন ক্রোনাসকে এবং সিংহাসনে আরোহণ করলেন, তখন ক্রোনাস পালিয়ে যায় ইতালিতে, আর জিউস সূচনা করেন এক স্বর্ণযুগের, যা তার মৃত্যুর আগপর্যন্ত টিকে ছিলো। ক্রোনাস ছাড়া আরো কয়েকজন টাইটান দেব-দেবী হলেনঃ

ওস্যান : তিনি ছিলেন ওস্যান নদীর অধিপতি, যে নদীটি মর্তকে বৃত্তের মতো ঘিরে আছে বলে মনে করা হতো,
টেথিস : ওস্যানের স্ত্রী। ওস্যান ও টেথিসের কন্যা ছিলো ওসেনিডগণ - ওস্যান নদীর উপনদীসমূহ,
হাইপেরিয়ন : সূর্যদেবতা, চন্দ্রদেবী ও ঊষাদেবীর পিতা,
নিমোসিনি : স্মরণশক্তির দেবী,
থেমিস : আইন ও ন্যায়ের দেবী,
অ্যাটলাস : যিনি তার কাঁধে বহন করেছিলেন পুরো পৃথিবী,
প্রমিথিউস : মানবজাতির রক্ষাকর্তা।

জিউসের সিংহাসন আরোহণে এরা ছাড়া বাকি টাইটান দেব-দেবী বিতাড়িত হয়ে যান, তবে এরাও গুরুত্বের বিবেচনায় অবনমিত হয়ে যান। টাইটানদের উত্তরসূরি হিশেবে যে সকল দেব-দেবী এলেন তাদের মধ্যে ১২ জন অলিম্পিয়ানকে শ্রেষ্ঠ ধরা হয়। গ্রীসের সর্ব-উত্তরে থেসালী’র সর্বোচ্চ পর্বত “মাউন্ট অলিম্পাস” এর শৃঙ্গ “অলিম্পিয়া” তে এরা বসবাস করতেন। গ্রীক কবি হোমারের “ইলিয়াড” কাব্যে অলিম্পাস সম্পর্কে বলা হয়েছে পৃথিবীর সকল পর্বতের মধ্যে উচ্চতম পর্বত, যার অবস্থান রহস্যময় এক স্থানে। প্রধান তিন দেবতা জিউস, পোসেইডন ও হেডিস সহ সব দেব-দেবীই অলিম্পাসে বাস করতেন। অলিম্পাসের প্রবেশদ্বার ছিলো মেঘনির্মিত, যার রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে ছিলো ঋতু-দেবতাগণ। দেবতারা সেখানে নিদ্রাযাপন করতেন, অ্যাপোলো’র বীণার সূরমুর্ছনা উপভোগ করতেন আর ভোজন সম্পন্ন করতেন অ্যামব্রোজিয়া ও নেকটার দিয়ে। হোমারের ভাষায়, সেখানে কখনো বায়ুপ্রবাহ আলোড়িত করেনি, লাগেনি কোন বৃষ্টি বা তুষারের ছোঁয়া, এর চারিদিকে ছেয়ে আছে মেঘমুক্ত অন্তরীক্ষ, সূর্যালোক যেখানে বিকীর্ন হয়ে পরে। এই পর্বতে বারোজন অলিম্পিয়ান মিলে তৈরি করলেন এক দেব-পরিবার। এই বারোজন হলেনঃ



The Jupiter de Smyrne, discovered in Smyrna in 1680[1] জিউস বা জুপিটার :

বিশ্বভ্রহ্মান্ড যখন তিন অলিম্পিয়ান দেবতা ভাগ করে নেন, তখন জিউসের ভাগে পরে সমগ্র স্থলভাগ ও মহাবিশ্ব। তিনি ছিলেন নভোমন্ডলের একচ্ছত্র অধিকর্তা, বৃষ্টি ও মেঘের দেবতা, অস্ত্র হিশেবে ব্যবহার করতেন ভয়ংকর বজ্রপাত। সকল দেব-দেবীদের সামষ্টিক শক্তির চেয়ে তার শক্তি ছিলো বেশি, তার নিজের ভাষায়, “আমিই সবচে শক্তিমান, প্রমাণ দেখতে চাইলে একটি স্বর্ণের রজ্জু বেঁধে দাও অলিম্পাসে, আমি একপাশ ধরে রাখি আর তোমরা সবাই মিলে টেনে নামানোর চেষ্টা করো। দ্যাখো আমাকে কেউ নামাতে পারে কিনা”। তবে অ্যাতোটা শক্তিমান ছিলেন না তিনি, তাকে ধোঁকা দেয়া যেত, বিরোধিতা করা যেত, বোকা বানানো যেত। পোসেইডন ও হেরা’র কাছে তার প্রতারিত হওয়ার কথা পাওয়া যায় “ইলিয়াডে”। প্রায়ই বলা হয় রহস্যময়তা কিংবা নিয়তি-দেব তারচে শক্তিশালী। জিউসের চরিত্র ঠিক দেবতাদের মতো ছিলো না, প্রায়ই তাকে বিভিন্ন নারীর সাথে প্রেমে লিপ্ত হতে ও নিজ স্ত্রী হেরাকে ফাঁকি দিতে কূট-কৌশলের আশ্রয় নিতে দ্যাখা যায়। তারপরেও তাকে সব দেব-দেবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলা হয়। তার বক্ষবর্ম ছিলো এক দুর্ভেদ্য ঢাল, যা তৈরী ছিলো শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয়ে, তার অস্ত্র ছিলো বজ্রপাত, তার পাখি ছিলো ঈগল, আর প্রিয় গাছ ছিলো ওকে। ওকে গাছ ঘেরা ডোডোনা ছিলো তার ভবিষ্যৎবাণী করার স্থান।
     

হেরা বা জুনো :
হেরা ছিলেন দেবতা জিউসের স্ত্রী ও ভগ্নী। টাইটান দেবতা ওস্যান ও তার স্ত্রী টেথিস হেরাকে লালন-পালন করতো। তিনি ছিলেন বিবাহের রক্ষাকর্ত্রী, বিবাহিত নারীদের ব্যপারে তার উদ্ভট আগ্রহ দ্যাখা যায়। তিনি কখনোই কোন মনোঃকষ্ট ভুলে যেতেন না, যার কারণে তার স্বামী জিউস যেসব নারীদের দিকে নজর দিয়েছিলো, তাদের শাস্তি দিয়েছিলেন তিনি। সেসব নারীদের, অ্যামনকি তার সন্তানদের কোন দোষ ছিলো কিনা তাও খতয়ে দ্যাখেননি হেরা। এক ট্রোজান, যিনি হেরা’র চেয়ে হেলেনকে বেশি সুন্দরী বলেছিলেন, তার উপর যদি হেরা’র তীব্র ঘৃণা না থাকতো তাহলে কোন পক্ষের পরাজয় ছাড়াই ট্রয়ের যুদ্ধ শেষ হতো। তার উপেক্ষিত সৌন্দর্যের রোষানলে পরে পুরে ছাই হলো ট্রয় নগরী। একমাত্র “স্বর্ণমেষের চামড়া অভিযান” ছাড়া অন্য কোথাও তাকে করুণাময়ী ও বীরসুলভ কাজের উৎসাহদাত্রী হিশেবে দ্যাখা যায় না। তবুও তার উপাসনা হতো সকল গৃহে, ক্যানোনা তিনি ছিলেন সেই দেবী যার কাছে বিবাহিত নারীরা আসতো সাহায্য প্রার্থনায়, যার কন্যা “ইথিলিয়া” সাহায্য করতো সকল সন্তানসম্ভবা নারীদের তাদের প্রসবকালে। দেবী হেরা’র কাছে পবিত্র ছিলো গাভী ও ময়ুর। আর্গস ছিলো তার প্রিয় নগরী।
     
Poseidon from Milos, 2nd century BC (National Archaeological Museum of Athens)পোসেইডন :
সমুদ্রের নিয়ন্তা পোসেইডন ছিলেন দেবতা রাজ জিউসের ভাই, গুরুত্বও বিশিষ্টতা বিবেচনায় জিউসের পরেই তার অবস্থান। ঈজিয়ান সাগরের উভয় তীরের সমুদ্রচারী গ্রীকদের দৈনন্দিত কাজকর্ম যেহেতু সমুদ্রকে ঘিরেই  হতো, তাই তাদের কাছে পোসেইডনই ছিলো সবকিছু।  টাইটান দেবতা ওস্যান’র কন্যা অ্যাম্ফিত্রিতি ছিলেন পোসেইডনের স্ত্রী। তাদের বাসস্থান ছিলো সমুদ্রের তলদেশে বিশাল এক প্রাসাদ, তারপরেও তাদের অলিম্পাস পর্বতেও দ্যাখা যেত। সমুদ্রের দেবতা হওয়া ছাড়াও তিনি মানুষকে সর্বপ্রথম ঘোড়া দান করেন, এই কারনেও মানুষের কাছে তিনি সম্মানিত ছিলেন। তাকে সাধারণভাবে ভূমিকম্প প্রদানকারী বলা হয়। তার সর্বসময়ের ব্যবহৃত হাতিয়ার ছিলো একটি ত্রিশূল – যা নাড়িয়ে তিনি ধ্বংস করে দিতে পারতেন সবকিছু। ঘোড়া ও ষাঁড়ের সাথে তার নাম জড়িয়ে আছে।
     
Hades with Cerberus (Heraklion Archaeological Museum)হেডিস বা প্লুটো :
জিউস ও পোসেইডনের ভাই, যার ভাগে পরেছিলো পাতালপুরী ও মৃতদের উপর নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা। তাকে প্লুটো বলা হতো সম্পদের দেবতা হওয়ার কারণে, মাটির অভ্যন্তরের সকল ধাতুর মালিক ছিলেন তিনি। গ্রীক-রোমান সকলেই তাকে হেডিস’র সাথে প্লুটো ও “Dis” লিখতো। যার অর্থ “ধনী”। তার একটি বিশেষ টুপি ছিলো যা পরলে অদৃশ্য হয়ে যেত। তিনি পাতালপুরী ছেড়ে খুব বেশি বাইরে অথবা অলিম্পাসে যেতেন না, তিনি কাঙ্ক্ষিতও ছিলেন না। তিনি ছিলেন করুণাহীন, অনুনমেয়, ন্যায়বান, ভয়ংকর কিন্তু কোন দুষ্ট দেবতা নন। তার স্ত্রী ছিলো পার্সিফোন, যাকে মর্ত থেকে অপহরণ করে এনে পাতালের রানী বানিয়েছিলেন। মৃতদের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকলেও তিনি মৃতদের দেবতা ছিলেন না। মৃতদের দেবতা হলেন “থ্যানাটস”, রোমানদের ভাষায় “ওর্কাস”।
     
Marble Greek copy signed "Antiokhos", a first century BC variant of Phidias' fifth-century Athena Promachos that stood on the Acropolisপ্যালাস এথেনা বা মিনার্ভা :
মিনার্ভা ছিলেন জিউসের কন্যা, শুধুই জিউসের কন্যা। কোন নারী তাকে গর্ভে ধারণ করেননি। পূর্ন অবয়বে ও বর্ম ধারণ করে তিনি জেগে উঠেন জিউসের মাথা থেকে। “ইলিয়াড” এ তিনি বর্নিত হয়েছেন এক ভয়ংকর ও নৃশংস যুদ্ধ-দেবী হিশেবে, কিন্তু অন্য সবখানে কেবল নিজ রাজ্য ও আবাসস্থল রক্ষাকর্ত্রী হিশেবে। তিনি প্রধানত নগরী-দেবী, সভ্য জীবন, চারুশিল্প ও কৃষিকাজের রক্ষাকর্ত্রী। তিনি ছিলেন লাগামের আবিষ্কারক, পোসেইডন হতে প্রাপ্ত ঘোড়া মানুষের ব্যবহারের উদ্দেশে ঘোড়াকে পোষ মানান। এথেনা ছিলেন জিউসের প্রিয়তম সন্তান, তার অভেদ্য ঢাল, বর্ম ও ধ্বংসাত্মক অস্ত্র বজ্রপাত এথেনাই বহন করতেন। তিনি ছিলেন ধূসর চোখের অধিকারী, বিচ্ছুরিত চোখের অধিকারীও বলা হয়। তিনজন কুমারী দেবীর মধ্য তিনি ছিলেন প্রধান। তাকে বলা হয় চির-কুমারী দেবী – “পার্থেনস”, তার মন্দির ছিলো “পার্থেনন”। তার প্রিয় নগরী এথেন্স ও প্রিয় বৃক্ষ জলপাই, প্রিয় পাখি পেঁচা।
     
Apollo Belvedere, ca. 120-140 CE.ফিবাস অ্যাপোলো :
তিনি জিউস ও লেটো বা ল্যাটোনা’র পুত্র, যাকে সবচে বেশি গ্রীকসূলভ বলা হয়। তিনি এক সুদর্শন দেবতা, মহান সুরস্রষ্টা – সোনালী বীণা বাজিয়ে মাতিয়ে তুলতেন অলিম্পাস পর্বত। তিনি ছিলেন রূপালী ধনুকের প্রভু, ধনুর্বিদ্যার দেবতা, সুনিপুণ তীরন্দাজ, নিরাময়ের দেবতা – মানুষকে যিনি শিখিয়েছিলেন নিরাময়বিদ্যা। এইসব চমৎকার বিদ্যার অধিকারী হওয়া ছাড়াও তিনি ছিলেন আলোর দেবতা, সত্যের দেবতা।  সুউচ্চ পার্নেসার নিচে ডেলফি ছিলো তার দৈববাণী করার স্থান। একে মনে করা হতো পৃথিবীর কেন্দ্র, গ্রীসের বাইরে থেকেও মানুষ আসতো এখানে তীর্থযাত্রায়। উপস্থিত তীর্থযাত্রীদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন এক সম্মোহিত যাজিকা, যিনি সম্মোহিত হতেন পাহাড়ের গভীর খাদ থেকে উত্থিত বাষ্প দ্বারা – যেখানে অ্যাপোলো আসন গ্রহণ করতেন। জন্মস্থান “ডেলোস” অনুসারে তাকে “ডেলিয়ান” নামে ডাকা হতো, পাইথন নামক ড্রাগন হত্যা করায় “পাইথিয়ান” নামেও ডাকা হতো। তাকে “লাইসিয়ান” নামেও ডাকা হতো, লাইসিয়ানের অনেক অর্থ আছে – নেকড়ে দেবতা, আলোর দেবতা, লাইসিয়ার দেবতা। হোমারের “ইলিয়াড” এ তাকে অভিহিত করা হয় “স্মিন্থিয়ান” নামে, যার অর্থ মুষিক-দেবতা। তাকে সূর্য-দেবতাও বলা হয়, তার নাম “ফিবাস” এর অর্থ দ্যুতিময় বা উজ্জ্বল, যদিও সূর্য-দেবতা ছিলেন টাইটান হাইপেরিয়নের সন্তান হেলিওস। ফিবাস অ্যাপোলো মানুষদের প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী দিতেন দেবতাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য। তার প্রিয় বৃক্ষ হলো লরেল, তার কাছে পবিত্র প্রাণী ছিলো ডলফিন ও কাক।
     
The Diana of Versailles, a Roman copy of a Greek sculpture by Leochares(Louvre Museum)আর্টেমিস বা ডায়ানা বা সিন্থিয়া :
জিউস ও লেটো বা ল্যাটোনা’র কন্যা, অ্যাপোলো’র জমজ বোন। তিনি ছিলেন অলিম্পাসের তিন কুমারী দেবীর একজন। আর্টেমিস ছিলেন বনের দেবী, দক্ষ শিকারী। পুরাণতত্ত্বে ট্রয়ের যুদ্ধের যে উল্লেখ রয়েছে, সেই ট্রয়ের উদ্দেশে গ্রীক নৌবহরের যাত্রাকে বিলম্বিত করেছিলেন যতক্ষণ না পর্যন্ত একজন কুমারীকে উতসর্গ করা হয়। অনেক কাহিনীতে তাকে বর্ননা করা হয় ভয়ঙ্কর রুপে, প্রতিশোধপরায়ণ রুপে। নারীরা যখন যন্ত্রণাহীন দ্রুত মৃত্যুবরণ করতেন, তখন ধরা হতো আর্টেমিস তাদের বধ করেছে তার রূপালী তীরের মাধ্যমে। তার ভাই অ্যাপোলোকে বলা হতো সূর্য-দেবতা, আর আর্টেমিসকে বলা হতো চন্দ্র-দেবী – “ফিবি” বা “সেলিনি” বা ল্যাটিন ভাষায় “লুনা”। এর কোনটিই যদিও তার প্রকৃত নাম ছিলো না। ফিবি ছিলো এক টাইটান দেবী, সেলিনি প্রকৃতপক্ষেই টাইটান চন্দ্র-দেবী। পুরাণ রচয়িতাগণ তাকে হেলিওসের বোনের সাথে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। পরবর্তী কাব্য সমূহে তাকে “ত্রিরূপী দেবী” বলা হয়, নভোলোকে সেলিনি, মর্তে আর্টেমিস, পাতালপুরী ও অন্ধকারে হেকাটি – অমাবস্যার দেবী। দেবী আর্টেমিসের প্রিয় বৃক্ষ সাইপ্রেস, প্রিয় ও পবিত্র প্রাণী হরিণ।
     
NAMA Aphrodite Syracuse.jpgআফ্রোদিতি :
প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতি “ইলিয়াড” অনুযায়ী জিউস ও ডাইওনের কন্যা, পরবর্তী কাব্যসমূহে সমুদ্র-ফেনা থেকে উত্থিত দেবী। একারণে আফ্রোদিতি নামের অর্থ বলা হয় সমুদ্র-ফেনা-হতে-উত্থিত, আর জন্মস্থান বলা হয় সিথেরার অদূরে, সেখান থেকে তাকে ভাসিয়ে সাইপ্রাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সিথেরা থেকে সাইপ্রাসে নিয়ে যাওয়ায় তাকে “সিথেরিয়া” বা “সাইপ্রিয়” নামেও ডাকা হয়। দেবী আফ্রোদিতি মোহমুগ্ধ করেছিলেন সকল দেবতা ও মানুষদের। তিনি ছিলেন তামাশা-প্রিয় দেবী, ছলনা ও অনুরাগের ভিতর দিয়ে উপহাস করতেন যাদেরকে তিনি জয় করেছিলেন তার কূট-কৌশলে। সৌন্দর্যের দেবী হওয়ায় সৌন্দর্য সবসময়ই তার পিছু নেয়, তাকে ছাড়া পৃথিবীর কোথাও আনন্দ বা স্নিগ্ধতা নেই। তার আরেকটি রুপ আছে, ছলনাময়ী ও বিদ্বেষপরায়ণ – তিনি মানুষের উপর প্রয়োগ করেন ভয়ঙ্কর ও ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা। আফ্রোদিতি ছিলেন খোঁড়া ও কুৎসিত দেবতা হেফিস্টাস (ভলকান) এর স্ত্রী। দেবী আফ্রোদিতির প্রিয় বৃক্ষ ছিলো মাটল ও প্রিয় পাখি পায়রা, কখনো কখনো চড়ুই ও রাজহাঁস।
     

So-called "Logios Hermes" (Hermes,Orator). Marble, Roman copy from the late 1st century BC - early 2nd century AD after a Greek original of the 5th century BC. Also known as Jeffrey. (jokes)হার্মিস বা মার্কারী :
জিউস ও অ্যাটলাস কন্যা মাইয়া’র পুত্র, মার্জিত ও দ্রুতগতিসম্পন্ন দেবতা। তার পায়ে থাকতো ডানাযুক্ত জুতো, ডানায় থাকতো শিরোনাস্ত্র ও জাদুদন্ড ক্যাডুসিয়াস। তিনি ছিলেন জিউসের বার্তাবাহক। হার্মিস ছিলেন সকব দেবতাদের মধ্যে সবচে ধূর্ত ও চালাক। জন্মের পর বয়স এক দিন অতিবাহিত হওয়ার আগেই তিনি এর প্রমাণ দ্যান অ্যাপোলো’র গাভীর পাল চুরি করে। পরে জিউস তাকে বাধ্য করেন গাভীর পাল ফেরত দিতে, এবং কচ্ছপের খোলক হতে তৈরিকৃত বীণা উপহার দিয়ে অ্যাপোলোর ক্ষমা লাভ করেন। হার্মিস ছিলেন মৃতদের আনুষ্ঠানিক পথ-নির্দেশক।
     
Statue of Ares from Hadrian's Villaঅ্যারেস বা মার্স :
জিউস ও হেরার পুত্র, যুদ্ধ দেবতা অ্যারেসকে তার পিতা-মাতা দুজনেই ঘৃণা করতেন। তিনি এসেছিলেন থ্রেস হতে, গ্রীসের উত্তর-পূর্বের রূঢ় ও ভয়ঙ্কর মানুষদের আবাসস্থল থেকে। হোমারের ইলিয়াডে তাকে বর্ননা করা হয়েছে নিষ্ঠুর দেবতা বলে, ঘাতক, রক্তপিপাসু, মরণশীলদের জন্য মূর্তিমান অভিশাপস্বরূপ, উদ্ভট রকমের ভীরু – যিনি আহত হলে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে পালিয়ে যান। অ্যারেসের সাথে ছিলেন তার বোন এরিস – কলহের দেবী, তার পুত্র স্ট্রাইফ। যুদ্ধের দেবী “ইনিয়ো” তার পাশ দিয়ে হেটে যান, তার সাথে আছে ত্রাসের দেবতা, কম্পনের দেবতা ও আতঙ্কের দেবতা। তারা যখন একসাথে সামনে অগ্রসর হন, তখন মর্ত ভেসে যায় রক্ত ও যন্ত্রণার আর্তনাদে। গ্রীক ও রোমান উভয়রাই তাকে পছন্দ করতো, তাকে দেখতো উজ্জ্বল সমর সাজে সজ্জিত এক দুর্ধর্ষ ও অজেয় দেবতারুপে। পুরাণতত্ত্বে অ্যারেসের গুরুত্ব কম। একটি কাহিনীতে তাকে দ্যাখা যায় আফ্রোদিতি’র প্রেমিকরুপে, আফ্রোদিতির স্বামী হেফিস্টাসের হাতে বন্দী হিশেবে। তার প্রিয় পাখি ছিলো শকুন, প্রিয় পশু কুকুর।
     
হেফিস্টাস বা ভলকান বা মালসিবার :
অগ্নিদেবতা হেফিস্টাস জিউস ও হেরা’র পুত্র, কখনো কখনো বলা হয় শুধু হেরা’র পুত্র। জিউস নিজ মাথা থেকে অ্যাথেনাকে জন্ম দিলে পাল্টা জবাব হিশেবে হেরা হেফিস্টাসকে জন্ম দ্যান। প্রচণ্ড সুন্দর ও অমর দেবতাদের মধ্যে একমাত্র হেফিস্টাস ছিলেন কুৎসিত ও খোঁড়া। হোমারের ইলিয়াডে বর্নিত হয়েছে, জন্মদানের পর হেরা যখন দেখলেন যে কুৎসিত এক সন্তানের জন্ম হয়েছে, তখন তাকে ছুড়ে ফেলে দ্যান অলিম্পাস থেকে। অন্য সব কাব্যে বলা হয় হেফিস্টাস হেরা’র পক্ষ নিলে জিউস ক্রোধান্বিত হয়ে এই কাজ করেন। কুৎসিত ও খোঁড়া হলেও তাকে অলিম্পাস পর্বত থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়নি, উল্টো তিনি ছিলেন উচ্চ সম্মানে আসীন, অমরদের শ্রম-পুরুষ, তাদের অস্ত্র ও বর্ম নির্মাতা, কর্মকার, বসতবাড়ি ও আসবাবপত্র নির্মাতা। তার নির্মান কারখানার পরিচারিকাদের তিনি সৃষ্টি করেছিলেন স্বর্ণ গলিয়ে। পুরাণ থেকে জানা যায় তার কারখানাটী ছিলো অজ্ঞাত কোন এক আগ্নেয়গিরির নিচে, যেখান থেকে প্রায়ই অগ্ন্যুৎপাত হতো। দেবতা হেফিস্টাসের স্ত্রী ছিলেন শ্রেষ্ঠ তিন সুখ ও সমৃদ্ধি প্রদায়ী তিন অলিম্পিয়ান দেবী’র অন্যতম – আফ্রোদিতি, যাকে অ্যাগলিয়াও ডাকা হতো। হেফিস্টাস ছিলেন শান্তি প্রিয় দেবতা, তিনি স্বর্গ ও মর্ত উভয় স্থানেই সমান জনপ্রিয় ছিলেন। দেবী অ্যাথেনার সাথে তিনিও ছিলেন নগরের পৃষ্ঠপোষক। হেফিস্টাস সাহায্য করতেন কর্মকারদের, আর অ্যাথেনা তাঁতিদের। ছেলে-মেয়েদের যে অনুষ্ঠানে নাগরিক সম্বর্ধনা দেয়া হতো, সেই অনুষ্ঠানেরও দেবতা ছিলেন হেফিস্টাস।
     
The Giustiniani Hestia in O. Seyffert, Dictionary of Classical Antiquities, 1894হেস্টিয়া বা ভেস্টা :
হেস্টিয়া ছিলেন জিউসের বোন, অবশ্যই তার পিতা ক্রোনাস, টাইটান। অ্যাথেনা ও আর্টেমিসের মতন তিনিও কুমারী দেবী ছিলেন। তার বিশেষ কোন ব্যক্তিত্ব ছিলো না, পুরাণে তার গুরুত্বও খুব বেশি নয়। হেস্টিয়া ছিলেন চুল্লীর দেবী, গৃহের প্রতীক, কোন নবজাতক জন্মগ্রহন করার পূর্বে তার থেকে ঘুরিয়ে আনা হত। প্রত্যেকের আহার শুরু ও শেষ হতো তাকে উতসর্গের মধ্য দিয়ে। প্রত্যেক নগরীতে একটি চুল্লী থাকতো, যার আগুন কখনোই নিভে যেত না, সেটা ছিলো হেস্টিয়ার পবিত্র চুল্লী। নতুন কোন নগরীর গোড়াপত্তনকালে অন্য নগরী থেকে চুল্লীর কয়লা নিয়ে আশা হতো, তা দিয়ে তৈরি হতো নতুন চুল্লী। “ভেস্টাল” নামক ছয়জন চিরকুমারী যাজিকা দ্বারা রোমে তার চুল্লীর রক্ষণাবেক্ষণ হতো।