বিজ্ঞান সহজায়ন : বিগ ব্যাং থেকে প্রোটোসেল

বিজ্ঞান সহজায়ন : বিগ ব্যাং থেকে প্রোটোসেল
কাফি রশিদ, ২৬/৫/১৪

গত শতাব্দীর শুরুতেও অধিকাংশ মানুষের ধারণা ছিল মহাবিশ্বের আয়তন নির্দিষ্ট, অপরিবর্তনশীল এবং মহাবিশ্বের সকল গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান একমাত্র আমাদের গ্যালাক্সিতে (নেবুলা)। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল নীহারিকা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন আমাদের গ্যালাক্সি ছাড়াও মহাবিশ্বে আরও অনেক গ্যালাক্সি আছে (তার এই আবিষ্কারের প্রায় সাত দশক পর মহাবিশ্বের মোট গ্যালাক্সির সংখ্যা প্রায় ১০০ বিলিয়ন বলে ধরা হয়)। বছরখানেক পর মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরির ১০০ ইঞ্চি ব্যাসের টেলিস্কোপের সাহায্যে তিনি ‘অ্যান্ড্রোমিডা’ নামক আমাদের নিকটতম গ্যালাক্সির দূরত্ব বের করে পূর্বে নির্ধারিত দূরত্বের সাথে তুলনা করে দ্যাখেন যে সেটি আমাদের গ্যালাক্সি থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। এই ঘটনার পর তিনি তার সহকর্মী মিল্টল হ্যুমাসনের সাথে আরও কিছু গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করেন এবং ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে তারা ঘোষণা করেন যে মহাবিশ্ব দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের এই ধারণা থেকে তারা মহাবিশ্বের সব গ্যালাক্সি একসময় একটি বিন্দুতে আবদ্ধ ছিল বলে মতামত দেন। এই ধারণা অবশ্য নতুন নয়, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে জর্জ ল্যামেত্র প্রস্তাব করেন মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ একটি আদি বিন্দু থেকে শুরু হয়েছিল।

দ্যা বিগ ব্যাং

পরবর্তীতে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার থেকে মহাবিশ্বের বয়স অনুমান করা হয় প্রায় ১,৩৮২ কোটি বছর, অর্থাৎ সমগ্র মহাবিশ্ব শুন্যে একটি বিন্দুতে আবদ্ধ ছিল প্রায় ১,৩৮২ কোটি বছর আগে। আবদ্ধ না বলে আমরা বলতে পারি মহাবিশ্বের সবকয়টি গ্যালাক্সির সকল বস্তু ও শক্তি সংকুচিত হয়ে অসীম ঘনত্বের একটি অতি ক্ষুদ্র বিন্দুর মতন ছিল। অতি ক্ষুদ্র বলতে, এই বিন্দুটির বিস্তার ছিল এক প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য, এর মানে, যদি ০.১ মিলিমিটার ব্যাসের দুইটি বিন্দু আঁকা হয় এবং প্রথম বিন্দুটি সবদিক থেকে টেনে খালি চোখে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সমান করেও এর ব্যাস ০.১ মিলিমিটার ধরা হয়, তাহলে দ্বিতীয় বিন্দুটির বিস্তার হবে প্রথম বিন্দুর সাপেক্ষে ১ প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য। এই অতি ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে মহাবিশ্ব সম্প্রসারনের সেই মুহূর্তকে আমরা 'বিগ ব্যাং' নামে জানি। অনেকে মনে করেন বিগ ব্যাং হচ্ছে সেই আদি বিন্দুর বিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ঘটনা, কিন্তু বিগ ব্যাং আদৌ কোন বিস্ফোরণ নয়, এটা হচ্ছে বিন্দু আয়তনের মহাবিশ্বের ক্রমশ প্রসারিত হয়ে বিশাল মহাবিশ্বে সম্প্রসারণের ঘটনা। 

বিগ ব্যাং কোন বিস্ফোরণ নয়, সম্প্রসারণ

একদম শুরুতে ১ প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যের আদি বিন্দুটির তাপমাত্রা ও ঘনত্ব ছিল অসম্ভব রকমের বেশি, কয়েকশ কুইন্টিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস ও ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কিলোগ্রাম/লিটার। আর এই বিন্দুতে ছিল চারটি মৌলিক বলের সমন্বয়, সবল নিউক্লিও বল (নিউট্রন ও প্রোটনের মধ্যকার বল), দুর্বল নিউক্লিও বল (হ্যাড্রন ও লেপ্টনের মধ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী বল), মহাকর্ষ বল (মহাবিশ্বে বস্তুসমূহের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ বল) ও তাড়িতচৌম্বক বল (ইলেকট্রন ও প্রোটনের মধ্যকার বল)। বিগ ব্যাং'র প্রথম সেকন্ডে বিন্দুটি সম্প্রসারিত হয়ে ফুটবলের সমান আয়তন নেয়, মহাকর্ষ বল অন্য তিনটি বল থেকে আলাদা হয়ে যায়। আয়তন বেড়ে যাওয়ায় ঘনত্ব ও তাপমাত্রা কমে গিয়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টির উপাদান কোয়ার্ক, ইলেকট্রন ও ফোটন সৃষ্টি হয়। অবশ্য এসময় ম্যাটার ও এন্টিম্যাটার সৃষ্টি হলেও পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ইতিমধ্যে অন্য তিনটি বলও পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং তাপমাত্রা আরও অনেক কমে গেলে কোয়ার্কেরা একত্রিত হয়ে গঠন করে প্রোটন ও নিউট্রন। 

পরবর্তী তিন সেকন্ডে সবল নিউক্লিও বলের প্রভাবে প্রোটন ও নিউট্রন মিলে নিউক্লিয়াস গঠন করে। ইতিমধ্যে মহাবিশ্ব দ্রুত ঠান্ডা ও সম্প্রসারিত হতে শুরু করেছে, কিন্তু কোন অণু তৈরি হয়নি। প্রায় ৩ লক্ষ ৮০ হাজার বছর সময় লেগে যায় নিউক্লিয়াসে ইলেকট্রন সংযোজিত হয়ে অণু গঠিত হতে, এসব ছিল মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের অণু। এসময় মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৫,৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও আয়তনে বর্তমানের কয়েক হাজার গুন ছোট। আরও প্রায় ৩০ থেকে ৫০ কোটি বছর পর মহাকর্ষ বলের প্রভাবে গ্যাসের মেঘদল সংকুচিত হতে হতে প্রচন্ড তাপমাত্রা ও ঘনত্বের একাধিক খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ২০ কোটি বছর পর তাপমাত্রা ১ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছালে এসব খন্ডে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া শুরু হয় এবং নক্ষত্রে পরিণত হয়। নক্ষত্রগুলোতে যথাক্রমে কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, আয়রন ইত্যাদি ভারী অণু সৃষ্টি হয়। ২৫ কোটি বছর পর বড় আকারের নক্ষত্রগুলো বিস্ফোরিত হয়, বিস্ফোরিত এসব নক্ষত্রের ধূলি ও গ্যাস মিলে গ্রহ সৃষ্টি করে এবং বিস্ফোরণের পর ভারী অণুগুলো গ্রহ থেকে গ্রহে ছড়িয়ে পড়ে। নক্ষত্রগুলোর এই বিস্ফোরণ 'সুপারনোভা' নামে পরিচিত। 

অনেকগুলো নক্ষত্র ও গ্রহ একসাথে গঠন করে এক একটি গ্যালাক্সি, আর ছোট ছোট একাধিক গ্যালাক্সি একসাথে গঠন করে অপেক্ষাকৃত বড় গ্যালাক্সি। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি গঠন করেছে এই ধরনের কয়েকটি ছোট আকারের গ্যালাক্সি। মিল্কিওয়েতে সূর্য তৈরি হয়ে সময় নিয়েছে ৮৮০ কোটি বছর এবং সূর্যকে কেন্দ্র করে সৌরজগৎ গঠিত হতে সময় লেগেছে ৯৩০ কোটি বছর। বিগ ব্যাং'র পর ধীরে ধীরে মৌলিক কণা, পরমাণু, ভারী অণু, গ্যাস ও ধূলি থেকে গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ ইত্যাদি সৃষ্টি হয়েছে, ব্যাপারটা কিন্তু অ্যামন নয়। মহাবিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আমাদের অজানা পদার্থে তৈরি, যারা দৃশ্যমান আলো অথবা তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ বিকিরণ করে না, শুধুমাত্র মহাকর্ষ বলের প্রভাব দ্বারা আমরা তাদের অস্তিত্ব নিরুপণ করতে পারি। এই অজানা পদার্থদের 'ডার্ক ম্যাটার' বলা হয়। ধারণা করা হয় বর্তমান মহাবিশ্বের মোট ভরের পাঁচ ভাগের চার ভাগ ভরই এসব ডার্ক ম্যাটারের, আর মোট ভর-শক্তির শতকরা ২৩ ভাগ। 

জানা-অজানা উপকরণে আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি হল, কিন্তু গ্রহে প্রাণের উদ্ভব হলো কী করে? আসলে প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বিগ ব্যাং'র ৭৫ কোটি বছর পরে, যখন নক্ষত্রে কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও আয়রন অণু সৃষ্টি হয়েছিল। সুপারনোভার ফলে প্রাণ সৃষ্টির এসব উপাদান অন্যান্য গ্রহের মতন আমাদের গ্রহেও এসে পড়েছিল। সৌরজগৎ গঠনের পর দ্যাখা গেল পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির প্রয়োজনীয় সব উপকরণ, যেমন তরল পানি, কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, সালফার, ফসফরাস ও কয়েক ধরনের শক্তি বিভিন্ন রুপে বিদ্যমান। একটি গ্রহে তরল পানিকে প্রাণ সৃষ্টির প্রাথমিক উপকরণ বলে ধরা হয়, এর কারণ হচ্ছে- তরল পানি থাকা মানে গ্রহে বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটবার জন্য সঠিক তাপমাত্রা বিদ্যমান এবং তরল পানি বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যকে পরস্পরের সাথে মিশে যেতে সাহায্য করে। আবার কার্বন হচ্ছে অ্যামন একটি মৌল যা চেইন-সদৃশ যৌগ গঠন করতে পারে। ফলে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরস্পরের সাথে বিভিন্ন উপায়ে বিক্রিয়া করে বিভিন্ন ধরনের অজৈব যৌগ, যেমন অ্যামোনিয়া, মিথেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড গঠন করে। এসব রাসায়নিক বিক্রিয়ার শক্তির যোগান আসে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্নির বিকিরণ অথবা বজ্রপাত থেকে সৃষ্ট বৈদ্যুতিক শক্তি হতে। পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমে আরও কমে এলে এসব অজৈব যৌগ পরস্পরের সাথে বিক্রিয়া করে বিভিন্ন সরল জৈব যৌগ, যেমন সুগার, ফ্যাটি এসিড, গ্লিসারল, অ্যামিনো এসিড, নাইট্রোজেন বেস ইত্যাদি গঠন করে। 


এদিকে কয়েক শতাব্দী ধরে বাষ্পীভূত পানি মেঘে রূপান্তরিত হয়ে বৃষ্টিতে পরিণত হয়ে সমুদ্র সৃষ্টি করে এবং সেখানে প্রচুর জৈব ও অজৈব যৌগ মিশে যায়। আদি জৈব যৌগসমূহ জটিল জৈব যৌগ গঠন করে, যেমন সুগার সংযুক্ত হয়ে স্টার্চ ও সেলুলোজের মতন জটিল পলি-স্যাকারাইড, ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারল যুক্ত হয়ে লিপিড, অ্যামিনো এসিড পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে পলিপেপটাইড ও প্রোটিন, বিভিন্ন নাইট্রোজেন বেস সুগার ও ফসফেটের সাথে যুক্ত হয়ে নিউক্লিওটাইড গঠন করে পরবর্তীতে যা নিউক্লিয়িক এসিড গঠন করে। জৈব যৌগ গঠনের ক্ষেত্রেও শক্তির সরবরাহ করে সূর্য। ধারণা করা হয় জটিল ও বৃহৎ জৈব যৌগসমূহ পরস্পরের সংস্পর্শে এলে আন্তঃআনবিক আকর্ষণ বলের কারণে পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে বৃহৎ ‘কোচারভেট’ গঠন করে। ফ্যাটি এসিডের মেমব্রেন এসব কোচারভেটকে ঘিরে রাখায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পরবর্তীতে এসব কোচারভেট সমুদ্র থেকে প্রোটিন ও অন্যান্য দ্রব্য শোষণ করে বৃদ্ধি পেতে থাকে। একসময় দ্যাখা যায় কোচারভেট বিপাক, বৃদ্ধি ও পুনরুৎপাদনের মতন প্রাণ কোষের প্রাথমিক গুণাবলি অর্জন করেছে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে নিউক্লিয়িক এসিড এসব কোচারভেটের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং সৃষ্টি হয়ে আদি প্রাণ কোষ প্রোটোবায়ন্ট বা প্রোটোসেল। 

এই প্রোটোসেল হচ্ছে পৃথিবী গ্রহে যাবতীয় প্রাণের আদি কোষ, আর প্রোটোসেলের জন্ম প্রায় ১৩০০ কোটি বছর আগে কোটি কোটি নক্ষত্রের বুকে সৃষ্ট বিভিন্ন মৌল থেকে। বিস্ফোরিত নক্ষত্র থেকে ছড়িয়ে যাওয়া সেসব মৌল আজও আমরা বয়ে চলেছি আমাদের শরীরে, আক্ষরিক অর্থে তাই আমরা সকলেই মৃত নক্ষত্রের সন্তান, মহাবিশ্বের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ। হয়তো দূর ভবিষ্যতে আমাদেরও বিবেচনা করা হবে অন্য কোন বিশেষ ঘটনার উপকরণ হিশেবে। 


তথ্যসূত্র : 

১। টাইমলাইন অফ দ্যা ইউনিভার্স, ফিজিক্স অফ দ্যা ইউনিভার্স ডট কম, 
২। স্টেপস ইন দ্যা অরিজিন অফ লাইফ, টিউটরভিসতা, 
৩। প্রোটোসেলস, এক্সপ্লোরিংঅরিজিনস ডট অর্গ, 
৪। দ্যা বিগিনিং অফ এভরিথিং, কুর্যগেসিগট, ইউটিউব, 
৫। বিগ ব্যাং, উইকিপিডিয়া, 
৬। স্পেস ফর কিডস, ইএসএ ডট আইএনটি।