ছিন্ন ভাবনা : নারী নেতৃত্ব ও ভাস্কর্য নির্মাণ হারাম ঘোষণা ইসলাম ধর্মের অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গীর ফসল

ছিন্ন ভাবনা : নারী নেতৃত্ব ও ভাস্কর্য নির্মাণ হারাম ঘোষণা ইসলাম ধর্মের অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গীর ফসল
কাফি রশিদ, ৭/৪/১৩

এক

কোন নারী দেশ বা জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারবে না, অথবা দিলেও সেই জাতি কখনো উন্নতি করতে পারবে না- ইসলামের নবি'র এই কথা তার অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গী ও হীণমন্যতার পরিচয় বহন করে। ব্যপারটা অ্যামন, (আরবের) ব্যাকবেঞ্চারদের পড়া জিজ্ঞেস করলে পারেনা তাই তাদের পড়াশুনার দরকার নেই। এ কথা সত্য যে আরবের নারীদের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা ছিলো না, অ্যাখনও নাই,নবি'র জন্মের বহুবছর আগে থেকেই তাদের চোখ-মুখ-হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে। তবে একেবারেই যে ছিলো না তা নয়, ইসলামী ইতিহাসে রাখঢাক সত্ত্বেও আরবে খাদিজা'র অবস্থান সেটাই প্রমাণ করে। 

যুদ্ধপ্রিয় বর্বর আরবদের নেতৃত্ব দিতে প্রয়োজন ছিলো কঠোর নিয়মকানুন বাস্তবায়নের জন্য পেশীশক্তির। পুরুষশোষিত আরবে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, কন্যাশিশু হত্যা, বিধর্মী ও যুদ্ধে নারীদের গণিমতের মাল হিশেবে গণ্য করা ইত্যাদি কারনে নারীদের সেই যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ ছিলো না, তারা অবলা নারীদের মধ্য থেকে অপেক্ষাকৃত যোগ্যকে নেতৃত্বের ভার দেয়া দূরে থাক, কখনো মানুষ বলেই মনে করেনি। পরবর্তিতে কোরআনে তাদের "মানুষ" হিশেবে স্বীকৃতি দিলেও তাদের অযোগ্য থেকে অযোগ্যতরে পরিণত করা হয়েছে শত শত নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

তৎকালীন আরবের অবস্থা চিন্তা করে ভবিষ্যত ও পুরো পৃথিবীর জন্য বিধিনিষেধ আরোপ প্রচন্ড বোকামি। আরবের বাইরে এখন সবক্ষেত্রে নারীদের পুরুষের সমান অধিকার দেয়া হয়, প্রমাণ করেছে তারা কোন অংশে পুরুষের চেয়ে কম নয়। খোদ মধ্যপ্রাচ্যেই একসময় নারী নেতৃত্ব ছিলো, আফ্রিকা, এমনকি বাংলাদেশেও মাতৃপ্রধান জাতি আছে। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি অব্যাহত রেখেছে নারীরা। রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক নারী আছেন যারা নিজেদের পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে যোগ্য বলে প্রমাণ করেছেন। যেসব বিষয় বিবেচনা করে ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম ঘোষণা করা হয়েছিলো সেসব অ্যাখন অযৌক্তিক। হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মীয় দলগুলোর নারী নেতৃত্ব নিষিদ্ধের দাবী তাদের ক্ষমতার প্রতি লোভ ও চৌদ্দশ বছর ধরে চলে আসা হীণমন্যতার পরিচয় দেয়।


দুই

মুহম্মদ ও তার মৃত্যু পরবর্তি নবিদের সময়ে নব্য মুসলিমদের মধ্যে ছবি আঁকা ও ভাস্কর্য সৃষ্টিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বর্তমানে সেই নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন নেই। শত বছর ধরে মৃত কিংবা জীবিত ব্যক্তির প্রতিকৃতিতে ও কোন ভাস্কর্যকে অতিপ্রাকৃত শক্তির মাধ্যম বিবেচনা করে মূর্তিপূজা করে আসা পৌত্তলিকেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের সেই পূজা করার প্রবণতা চলে যায়নি, এই প্রবণতা ছিলো অন্যান্য আহলে হাদিসদের মধ্যেও। এই প্রবণতা ছিলো খোদার ইবাদাত-অস্তিত্বের প্রতি হুমকিস্বরুপ, যার প্রথম প্রমাণ নূহ'র সময়ে তার অনুগত কিছু ভক্তের মৃত্যু হলে তাদের ভাস্কর্য তৈরির কিছুদিন পর যখন সবাই তাদের বিশেষ কেউ গণ্য করে খোদার বদলে সেই ভাস্কর্যগুলোর পূজা করা শুরু করেছিলো। নূহের পর অন্যান্য নবি-রসুলদেরও প্রতিকৃতি তৈরি করে ও ছবি এঁকে সেগুলোর পূজা করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা কিনা নবি-রসুলদের খোদার সমকক্ষ হিশেবে দাড় করেছিলো। এই নব্য মুসলিমদের ইবাদাতে খোদা ভিন্ন অন্য কোন সত্তার অনুপস্থিতি নিশ্চিত করে ইসলাম ধর্মের আইডিওলজি ঠিক রাখতে তাই মূর্তি সৃষ্টি ও ছবি আঁকা নিষিদ্ধ ব্যতীত কোন উপায় ছিলো না। 

এই নিষিদ্ধকরণ যে সঠিক ছিলো তার প্রমাণ এখনো পাওয়া যায় উপমহাদেশের "কদম রসুল" নামক উদ্ভট কিছু স্থানে, যেখানে অজ্ঞাত ব্যক্তির পায়ের ছাপকে মুহম্মদের পায়ের ছাপ বিবেচনা করে "পূজা" করা হয়, আরও পাওয়া যায় সিলেট-চট্টগ্রামের মাজারগুলোতে। তবে এর সবগুলোই ধর্ম সম্পর্কিত, যেগুলোর বাইরে ভাস্কর্য সৃষ্টি ও ছবি আঁকা নিষিদ্ধের প্রয়োজনীয়তা দ্যাখা যায়না। এই যে খোদার ইবাদাতে কোন সত্তা ভাগ বসাচ্ছে না, তার অস্তিত্ব সংকটে পরছে না, এই ধ্যানধারণা থেকেই ইসলাম ধর্মে প্রয়োজনে ছবি তোলা জায়েয ঘোষণা করেছেন আলেম-ওলামা-বুজুর্গ ব্যক্তিবর্গ। ঠিক একই যুক্তি খাটে ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও, যেগুলো কোন পূজার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয় না, যেগুলো দেখলে কারো পূজা করার কথা মাথায় আসে না, এগুলো আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য- সংস্কৃতি ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য বহন করে। এই বাস্তব উপলব্ধিই ইসলাম ধর্মের আইডিওলজি অক্ষুণ্ণ রেখে ভাস্কর্য হালাল ঘোষণা করে ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন।

সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম সরকারের কাছে তেরোটি দাবী জানিয়েছে যার মধ্যে একটি ঢাকা সহ সারাদেশের সব ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এই ভাস্কর্যগুলোর প্রায় সব কয়টিই মহান মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ করে। আমাদের দেশের কেউ কখনো ভাস্কর্যগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে পূজা করে না, কেউ সিজদাহ করে না, বড়জোর তারা মাথা নুইয়ে তাদের কৃতকর্মকে সম্মান প্রদর্শন করে যার সাথে শিরকের কোন সম্পর্ক নেই। ধর্মের নামে তাদের দাবী সম্পূর্ন ভিত্তিহীন।