গ্রীক বীর বেলেরোফোনের পেগাসাস জয়, কাইমেরা বধ ও প্রণয়কাহিনী

গ্রীক বীর বেলেরোফোনের পেগাসাস জয়, কাইমেরা বধ ও প্রণয়কাহিনী
কাফি রশিদ, ২/১১/১২

(গ্রীক ডেমি-গড পার্সিউসের মেডুসা-বধ ও অ্যান্ড্রোমিডা-প্রণয়কাব্যের ধারাবাহিকতায় হেসিওড, হোমার ও পিন্ডার বর্ননা করেছেন বেলেরোফোনের পেগাসাস-জয়, কাইমেরা-বধ ও অ্যান্টিয়া-অ্যান্টিক্লিয়া-প্রণয় কাহিনী। ইউরিপিডাস এই নিয়ে একটি নাটকও লিখেছিলেন।)

সিসিফাসের পুত্র গ্লকাস ছিলেন ইফার নগরীর রাজা, যেই নগরীকে পরবর্তীতে “করিন্থ” বলা হতো। তার পিতা সিসিফাস জিউসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার ফলস্বরুপ হেডিসে চিরকাল এক খন্ড পাঁথর পর্বতের গা বেয়ে তোলার শাস্তি পেয়েছিলেন। গ্লকাস নিজেও নিজের উপর টেনে এনেছিলেন দেবতাদের অসন্তোষ। তিনি ছিলেন একজন তুখোড় অশ্বারোহী, নিজের ঘোড়াগুলোকে আরো তাগড়া করার জন্য সেগুলোকে খাওয়াতেন নর-মাংস। অ্যামন বীভৎস কাজ দেবতাদের ক্রোধান্বিত করে তুলতো। শাস্তি হিশেবে যা পেল তা নিজের কৃতকর্মেরই প্রতিচ্ছবি। একবার ঘোড়ায় টানা রথে করে গ্লকাস কোথাও যাচ্ছিলেন, তখন দেবতারা তাকে ছুড়ে ফেলে দিলেন নিচে। আর ঘোড়াগুলো তাকে ছিন্নভিন্ন করে টুকরো টুকরো করে গলাধঃকরণ করলো।

রাজা গ্লকাসের পুত্র ছিলেন বেলেরোফোন, দুর্দান্ত সাহসী এক তরুণ – প্রচণ্ড তেজ ও শারীরিক অসাধারণত্বের জন্য যাকে সমুদ্র-দেবতা পোসেইডনের পুত্র বলেও মনে করা হতো। পিতা যিনিই হোক, তার মাতা ছিলেন একজন মরণশীল মানুষ – ইউরিনোমি। মরণশীল মানুষের পুত্র হলেও দেবী অ্যাথেনা তাকে দীর্ঘদিন শিক্ষা-দীক্ষা দিয়েছিলেন যতোদিন না পর্যন্ত সে দেবতাদের সমপর্যায়ে পৌছে। কাজেই বেলেরোফনকে মরণশীল মানুষের চেয়ে দেবতা মনে করাটাই স্বাভাবিক ছিলো। প্রচণ্ড সাহসী বেলেরোফোন যে কাজের জন্য নিজেকে উপযুক্ত মনে করতো সেই কাজ থেকে তাকে কখনোই পিছু হটানো যেতো না, মিথ রচয়িতার ভাষায় –

যা মানুষ অসম্ভব বলে স্থির করতো,
যার আশা মানুষ ছেড়ে দিতো – ভেবে উপরের দৈব-শক্তিই
যা করতে পারে,
তার হাতে তাই-ই সম্পন্ন হতো সাবলীল পারঙ্গমতায়।

পার্সিউসকে য্যামন মর্তের যেকোন কিছুর চেয়ে আকৃষ্ট করেছিলো গর্গন মেডুসা’র মাথা, তেমনি করে মেডুসা’র রক্ত থেকে জন্ম নেয়া ডানা-অলা মনোমুগ্ধকর ঘোড়া পেগাসাস আকৃষ্ট করেছিলো বেলেরোফোনকে। মিউজদের পর্বত হেলিকনের হিপ্পোক্রিন ঝর্নার সামনে পেগাসাস সর্বপ্রথম আবির্ভূত হয়েছিলো। সবারই চাওয়া ছিলো পেগাসাসকে লাগাম পড়ানোর। বেলেরোফোন সাহায্যের জন্য চলে গেলেন ইফারের (করিন্থ) জ্ঞানী ভবিষ্যদ্বক্তা পলিডাসের কাছে। পলিডাস বেলেরোফোনের আকাঙ্ক্ষার কথা শুনে তাকে পরামর্শ দিলেন অ্যাথেনা’র মন্দিরে গিয়ে নিদ্রা-যাপনের জন্য। এই সেই দেবী অ্যাথেনা যিনি পার্সিউসকে সাহায্য করেছিলেন মেডুসা-বধের জন্য। কথিত আছে অ্যাথেনা’র মন্দিরে নিদ্রা-যাপন করলে দেবী স্বপ্নে নিদ্রাচ্ছন্নের দেখা দেন। বেলেরোফোন তা-ই করলেন। স্বপ্নে দেবী তাকে দেখা দিলেন, আর বললেন জেগে উঠলে সে অ্যামন এক্কটি জিনিশ দেখবে যা পেগাসাসকে মুগ্ধ করবে। ঘুম থেকে উঠে সত্যি সত্যিই বেলেরোফোন দেখলেন স্বর্ণের তৈরী একটি লাগাম যা আগে কখনো দেখা যায়নি। আশাবাদী বেলেরোফোন লাগামটি নিয়ে বের হয়ে গেলেন পেগাসাসকে খুঁজতে। অনেক জায়গা খোঁজাখুঁজি করে একসময় পেগাসাসকে দেখা গ্যালো ইফারের বিখ্যাত ঝর্ণা পিরিনের সামনে। পেগাসাস পানি পান করছিলো, বেলেরোফোন যখন তার সামনে গেলেন তখন সে মোটেই ভীত না হয়ে পানি পান করছিলো। বিদ্যুৎ গতিতে বেলেরোফোন লাগাম পড়িয়ে পেগাসাসের পিঠে চেপে বসলেন। কোন অসুবিধা ছাড়াই অ্যাথেনা’র জাদু কাজ করলো। সম্পুর্ন পোষ মেনে গ্যালো বেলেরোফোনের। অ্যাখন সে বায়ুর প্রভু, যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারে। ঘোড়াটিও তার প্রভুর মতোই প্রাণোচ্ছল। একটা সময় আসলো যখন দ্যাখা গ্যালো শুধু উড়াউড়ির জন্যই নয়, বিপদেরও বন্ধু পেগাসাস।


বেলেরোফোন ও পেগাসাস

কোন এক অজ্ঞাত কারণে বেলেরোফোন তার ভাই ডেলিয়াডিস-কে খুন করে আর্গসে চলে গেলেন। সেখানে রাজা অ্যাক্রিসিউসের ভাই প্রোটিউস তাকে আশ্রয় দিলেন। সেখানে তার বিচারকার্য শুরুর পর কোন একসময় প্রোটিউসের স্ত্রী অ্যান্টিয়া তার প্রেমে পরে প্রত্যাখ্যাত হন। ক্ষুদ্ধ অ্যান্টিয়া তার স্বামী প্রোটিউসকে বললেন বেলেরোফোন তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনমিলনে বাধ্য করেছেন। যদিও প্রোটিউস ক্রোধান্বিত ছিলেন, কিন্তু তাকে হত্যা করলেন না। কারণ অ্যাক্রিসিউসের মতো তারও প্রবল দেবতা-ভীতি ছিলো। তবে তিনি অ্যামন এক পরিকল্পনা করলেন য্যানো বেলেরোফোনের মৃত্যু হয়। প্রোটিউস বেলেরোফোনকে তার শ্বশুর লাইসিয়া’র রাজার আইয়োবেটিসের কাছে একটি পত্র পৌছে দিতে অনুরোধ করলেন। বেলেরোফোন খুশি মনে পেগাসাসের পিঠে চরে উড়ে লাইসিয়া চলে গেলেন।


পেগাসাসে চরে উড়ার পথে বেলেরোফোন

সেখানে লাইসিয়ার রাজা তাকে লাইসিয়ান প্রথা অনুযায়ী নয়দিন আতিথেয়তা প্রদান করার পর পত্রটি দেখতে চাইলেন। পত্রে প্রোটিউস রাজাকে অনুরোধ করেছিলেন য্যানো বেলেরোফোনকে হত্যা করা হয়, ক্যানোনা বেলেরোফোন তার স্ত্রী, অর্থাৎ আইয়োবেটিসের জ্যেষ্ঠ কন্যা অ্যান্টিয়াকে ধর্ষণ করেছেন। কিন্তু আইয়োবেটিস বেলেরোফোনকে হত্যা করলেন না, তার ভয় ছিলো অতিথিকে হত্যা করলে দেবতাদের অভিশাপ বর্ষিত হবে। তাই তিনিও বিকল্প উপায় হিশেবে বেলেরোফোনকে অনুরোধ করলেন অপরাজেয় ভয়ঙ্কর প্রাণী “কাইমেরা” বধ করতে, ক্যানোনা কাইমেরা তার পাশের রাজ্য কারিয়া’র মানুষের ভীতির কারণ ছিলো। রাজা সুনিশ্চিত ছিলেন যে কাইমেরা বেলেরোফোনকে হত্যা করবে। কাইমেরা’র মাথা ছিলো সিংহের মতন, শরীর ছাগলের মতন আর লেজ ছিলো সাপের মতন, আর মুখ দিয়ে সর্বদা আগুন বেরুতো। পেগাসাসের সহযোগীতায় বেলেরোফোন উড়ে গিয়ে কাইমেরার মুখে সীসা ঢেলে দিলেন, কাইমেরার মুখনিঃসৃত আগুনে সীসা গলে গেলে কাইমেরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গ্যালো। লাইসিয়ায় ফিরে এসে বধের সংবাদ জানাতেই আইয়োবেটিস তাকে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা সলিমি-দের বিরুদ্ধে এক অভিযানে পাঠালেন। সেখানেও প্রচণ্ড যুদ্ধ শেষে সফল বেরেলোফোনকে এবার পাঠানো হলো আমাজনদের বিরুদ্ধে। আমাজনেরা ছিলো দুর্ধর্ষ নারী যোদ্ধা, তাদেরকে অনেক সৈন্যের প্রাণের বিনিময়ে হারিয়ে যখন বেলেরোফোন লাইসিয়ায় ফিরে আসলেন, তখন তাকে আবার পাঠানো হলো কারিয়া’র ভয়ঙ্কর জলদস্যু কারিয়ামারাস-কে হত্যা করতে। তাকে হত্যা শেষে যখন বেলেরোফোন লাইসিয়ায় ফিরে এলেন তখন আইয়োডিস তাকে হত্যার বদলে বন্ধু হয়ে গেলেন। আর নিজের ছোট মেয়ে ফিলোনে-কে (অ্যান্টিক্লিয়া) বেলেরোফোনের সাথে বিয়ে দিলেন, বেলেরোফোন উপহার হিশেবে পেলেন আইয়োবেটিসের রাজ্যের অর্ধেকটা।


ফিলোনে (অ্যান্টিক্লিয়া)



বেলেরোফোনের কাইমেরা বধ

দীর্ঘদিন সুখী জীবন-যাপন শেষে পিতামহ ও পিতার মতো বেলেরোফোনও দেবতাদের ক্ষেপিয়ে তুললেন। কাইমেরা-বধের পর বেলেরোফোনের ধারণা হয়েছিলো সেও দেবতাদের সাথে অলিম্পাসে থাকার যোগ্য। এই ভেবে সে পেগাসাসকে নিয়ে অলিম্পাস পর্বতে আরোহণ শুরু করলেন। দেবতা জিউস ক্ষেপে গিয়ে পেগাসাসের দিকে বজ্রনিক্ষেপ করেন। ভয়ে পেগাসাস তাকে পিঠ থেকে ফেলে দিলে বেলেরোফোন অ্যালীয়ন উপত্যকায় পরে যান। সেখানে দীর্ঘদিন একাকী যন্ত্রণাপূর্ন জীবন-যাপনের পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

এরপর পেগাসাসের স্থান হয়েছিলো দেবতা জিউসের আস্তাবলে। কথিত আছে জিউস যে বজ্র ছুড়ে মারতেন, তা পেগাসাস বহন করে আনতো। এ ঘটনার দীর্ঘদিন পর যখন হারকিউলিসের জন্ম হয়, তখন জিউস হারকিউলিস-কে উপহার হিশেবে পেগাসাস দেন।