পাইরামাস ও থিসবি'র করুণ প্রেমোপাখ্যান এবং তুষারশুভ্র মালবেরী ফলের বর্ণ পরিবর্তন

পাইরামাস ও থিসবি'র করুণ প্রেমোপাখ্যান এবং তুষারশুভ্র মালবেরী ফলের বর্ণ পরিবর্তন
কাফি রশিদ, ২৪/১১/১২

অনেক অনেক আগে মালবেরী গাছের গাঢ় লাল বর্ণের বেরীগুলো কিন্তু লাল ছিলো না, ছিলো তুষারের মতোন শাদা। শাদা থেকে বর্ণ পরিবর্তনের পেছনে আছে এক করুণ, দুঃখময় ও ড্র্যামাটিক ঘটনা। ঘটনাটি এক তরুণ ও এক তরুণীর প্রেমকাহিনীকে ঘিরে।



এভাবেই যোগাযোগ রাখতো তারা।

রানী সেমিরাসের নগরী ব্যাবিলনে সাধারণ মানুষের জন্য বানানো বাড়িগুলো অ্যামনভাবে ছিলো যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্যাখা যেতো পাশাপাশি দুইটি বাড়ির জন্য একটি দেয়াল কমন-ওয়াল হিশেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অ্যামন দুইটি বাড়ির একটিতে ছিলো ব্যাবিলনের সবচে সুদর্শন যুবক পাইরামাস'র বাস, অপরটিতে সবচে সুন্দরী তরুণী থিসবি'র বাস। ছোটবেলা থেকে পাশাপাশি বসবাস করতে করতে তারা পরস্পরকে ভালোবেসে ফেললো, যেটা তাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক ছিলো। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বিয়ে করার, কিন্তু চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী তাদের মা-বাবা তাতে বাদ সাধলেন। কিন্তু তাদের প্রেমতো দমিয়ে রাখার জিনিশ না, কাজেই তারা তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা ছিলো প্রায় অসম্ভব।


থিসবি, দেয়ালে কান লাগিয়ে।

একদিন থিসবি'র মা-বাবা ওর বাইরে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। তাদের দুইটি বাড়ির মাঝে যে দেয়ালটি কমন হিশেবে ছিলো, সেই দেয়ালে একটি ছিদ্র ছিলো যেটি কেউ লক্ষ্যই করেনি। প্রেমিক-প্রেমিকা বলে কথা, সরু ছিদ্রটি তাদের চোখ এড়ায়নি। তারা দুইজন সেই ছিদ্র দিয়ে খুব কষ্ট করে যোগাযোগ চালিয়ে যেতে লাগলো। কষ্ট হলেও তাতে রোমান্টিকতার বিন্দুমাত্র বাকি ছিলো না। ছিদ্রের একপাশে থিবসি কান লাগিয়ে রাখতো - অপর পাশে পাইরামাস কথা বলতো, আবার পাইরামাস কান লাগিয়ে রাখতো - থিসবি কথা বলতো। এইটুকুই বা কম কী? কিন্তু কথা বলে আর কথা শুনে কী আর আশ মেটে? তাই তারা ঘুমুতে যাওয়ার আগে দেয়ালেই চুমু দিয়ে যেতো।

অ্যামন করে ভালোবাসাবাসি অনেক দিন চললো, এতোদিনে ধৈর্য্য একটু একটু করে কমছিলো। যেদিন ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গেই গ্যালো, সেদিন তারা সিদ্ধান্ত নিলো বাসা থেকে পালিয়ে যাবে। তারপর নগরী থেকে দূরে কোথাও - যেখানে ভোর এসে সত্যি সত্যি নিবিয়ে দেয় নক্ষত্রগুলোকে, ঘাসের উপর জমে থাকা শিশিরবিন্দু পালিয়ে যায় সূর্যালোকের আগমনে, সেখানে গিয়ে বাস করবে। তারপর সেদিন রাতে “নিনাসের সমাধি” নামক এক পরিচিত জায়গার এক মালবেরী গাছের নিচে দ্যাখা করার সিদ্ধান্ত নিলো। তুষারশুভ্র মালবেরী ফল গাছের পাশেই ছিলো এক ঝর্ণা।

অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে দিন শেষে রাত এলো। রাতের অন্ধকারে থিসবি চুপচাপ বেরিয়ে পরে নিনাসের সমাধিতে রউনা দিলো। পৌছে দেখে পাইরামাস তখনো পৌছেনি। তার জন্য অপেক্ষার একপর্যায়ে থিসবি দেখতে পেলো এক সিংহী ঝর্নার দিকে আসছে। সম্ভবত সিংহী সবে খেয়ে এসেছে, তার মুখে রক্ত দ্যখা যাচ্ছিলো। থিসবি সিংহীকে দেখে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো, পালিয়েও গ্যালো, তবে তাড়াহুড়ায় তার শাদা ওড়নাটি পরে গ্যালো মাটিতে। সেটি কুড়িয়ে নেয়ার সময় ছিলো না, তাই না নিয়েই নিনাসের সমাধির এক গুহায় আশ্রয় নিলো। পানি পান করে চলে যাওয়ার সময় সিংহী ওড়নাটি দেখতে পেয়ে মুখে পুরে নিয়ে কিছুদূর গিয়ে মুখ থেকে ফেলে দিলো।

এদিকে পাইরামাস নিনাসের সমাধির দিকে এগিয়ে আসছিলো। পথে থিসবির ওড়না, যেটিতে রক্তমাখা ছিলো, আর মাটিতে সিংহের পায়ের ছাপ দেখে সে ভাবলো থিসবিকে বুঝি সিংহ মেরে ফেলেছে। আরেকটু আগে আসলে হয়তো থিসবিকে রক্ষা করা যেতো, যথাসময়ে না আসায় থিসবি মরে গ্যালো ভাবতে ভাবতে পাইরামাস নিজেকে দায়ী করলো থিসবির মৃত্যুর পেছনে। সে সিদ্ধান্ত নিলো নিজের প্রাণ তার ভালোবাসার উদ্দেশ্যে বিসর্জন দেয়ার। থিসবি নিজেকে বিসর্জন দিতে পারলে সে ক্যানো পারবে না? কাজেই সে প্রেমিকার ওড়নাটি নিয়ে তাদের লক্ষ্যস্থল মালবেরী গাছের নিচে পৌছে তার তরবারি বের করে নিজেকে বিদ্ধ করতে লাগলো, আর রক্ত দিয়ে রাঙিয়ে দিলো ওড়না ও শাদা শাদা বেরী ফলের ভারে নত মালবেরী গাছটিকে।

আর ওদিকে থিসবি যখন ভাবলো সিংহীটি নিরাপদ দুরুত্বে চলে গেছে, তখন সে মালবেরী গাছের নিচে আসার প্রয়োজন মনে করলো। আরেকটি ভয় ছিলো তার, যদি পাইরামাস এসে তাকে না পেয়ে ভুল বুঝে ফেরত চলে যায়? মালবেরী গাছটির যেখানে থাকার কথা সেখানে এসে তুষারশুভ্র বেরী ফলের গাছটিকে সে পেলো না, তার পরিবর্তে সেখানে রক্তে রাঙা লাল বেরী ফলের গাছ। গাছের নিচের দিকে সামান্য নড়াচড়ার শব্দ শুনে সে তাকিয়েই আর্তচিৎকার করে উঠলো। সেখানে শুয়ে ছিলো পাইরামাস, রক্তে রাঙা ও তরবারির আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন।


থিসবি ও পাইরাবাস, শেষমুহূর্তে।

হায়! তাকে চুমু খেয়ে কথা বলার সময়টুকুও থিসবি পেলো না, মৃতপ্রায় পাইরামাস একবারের জন্য চোখ মেলে তাকিয়েই বন্ধ করে দিলো চিরতরের জন্য। পাইরামাসের নিস্প্রাণ দেহের পাশে তার ওড়না ও তরবারি দেখতে পেয়ে তার আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না, তবে এবার তো পাইরামাসের মতোন ভুল বোঝার উপায় নেই - তার সামনেই তো পরে আছে মৃত পাইরাবাস। প্রেমিক তার ভালোবাসার জন্য উতসর্গ করেছে তার প্রাণ, সে ক্যানো পারবে না? নিজেও তরবারি চালিয়ে দিলো তার হৃৎপিন্ড বরাবর।

অবশেষে দেবতাদের সহানুভূতি জাগলো তাদের প্রতি, হয়তো তারা পরীক্ষা করছিলেন তাদের ভালোবাসার গভীরতা। কিন্তু সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই বা কী! মরণশীল মানুষের প্রাণ তো আর ফিরিয়ে দেয়া যাবে না। তাই তাদের ভালোবাসার নিদর্শনস্বরুপ মালবেরী গাছের ফলকে চিরতরে লাল বর্ণের করে দেয়া হলো। বাবা-মাও বুঝতে পারলেন তাদের ভালোবাসার প্রকৃতি, তাদের দেহভস্ম সংগ্রহ করে রেখে দিলেন নিনাসের সমাধিতে।


সূত্র :
ল্যাটিন কবি ওভিদের কাব্য অবলম্বনে রচিত এডিথ হ্যামিল্টনের মিথলজি, উইকিপিডিয়া।