ছোটবেলার যতো কুসংস্কার

ছোটবেলার যতো কুসংস্কার
কাফি রশিদ, ৮/৩/১২

অনেকদিন থেকে ইচ্ছা ছিলো কুসংস্কার/অন্ধবিশ্বাস নিয়ে একটা পোস্ট দিবো। কয়েক লাইন লিখার পর আর লিখা হয়না, ইন্টারেস্টও থাকেনা। এখন থেকে কোন কুসংস্কার/অন্ধবিশ্বাস মনে পরলে এই পোষ্টে লিখবো।

# পরে যাওয়া দাঁত ইঁদুরের গর্তে রেখে আসলে নতুন যেই দাঁত গজাবে সেইটা ইঁদুরের দাতের মতোন ধারালো আর শাদা হবে, এমনটা বিশ্বাস করতোনা এমন মানুষ খুবই কম। আমাদের বাসার সামনেই রাস্তা ছিলো, ইঁদুরের গর্ত থাকার মতো কোন জায়গা ছিলোনা। এই কারনে দাঁত পরে গেলে আম্মুর সাথে ছাঁদের টবে পুঁতে ফেলতাম। বিশ্বাস করতাম কোন একসময় ইঁদুর এসে দাঁত নিয়ে যাবে। ছাঁদে নেয়ার সময় কাক যেন দাঁত না দেখে সেদিকেও খেয়াল রাখতাম, কাক যদি দাঁত দেখে তাহলে নতুন দাঁত হবেনা!

# ভরদুপুরে অথবা সন্ধ্যায় কোন মেয়ে চুল ছেড়ে বাইরে গেলে তার উপর জ্বীন আছর করবে, এইটা এখনো অনেকে বিশ্বাস করে। চুল ছেড়ে বাইরে যাওয়ার সাথে জ্বীন আছর করার কোন সম্পর্ক দেখিনা। ছোটবেলায় আমাদের পাশের বাসায় একটা মেয়ে সন্ধ্যায় চুল ছেড়ে বাইরে যাওয়ায় তার উপর "লাল, শাদা, কালো আর নীল মিয়া" ভর করেছিলো শুনেছিলাম। অনেকদিন ঐ বাসায় আশেপাশেও যাইনি রংধনু জ্বীনের ভয়ে!

# ফলের বিচি গিলে ফেললে পেটে গাছ হবে, এইটা কমন ধারনা। পেটে গাছ হবে ভেবে ছোটবেলায় তরমুজ খাইনি। বিচি আছে এমন ফল খাওয়ার সময় আগে বিচিগুলো ফেলে দিতাম। এখনো তরমুজ খাইনা, বিচি'র জন্য। তবে পেটে গাছ হবে এইটা ভেবে না, কামড় লাগলে বিরক্ত লাগে এইজন্য।

# নানু'র ধারনা রাতের বেলা নখ কাটলে আয়ু কমে যায়। নানু'র থেকে এই ধারনা আম্মু'র মধ্যেও চলে আসছে। আম্মু কখনোই রাতে নখ কেটে দিতোনা। দিনেরবেলা স্কুল, খেলাধুলা, পুংটামিতে বিজি থাকায় বেশিরভাগ সময় রাতেই নখ কাটতে হতো। প্রত্যেকটা নখ কাটা হতো আর আফসোস করতাম কতদিন আয়ু কমে গেলো!

# ছোটবেলায় কারো মাথার সাথে আমার মাথা গুঁতা লাগলে আরেকটা গুঁতা মেরে নিতাম, তা নাহলে মাথায় শিং গজাবে!

# পিঁপড়া অথবা আঁখের লাল অংশ খেলে সাঁতার শেখা যায় এইটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম। কোনটাই খাইনি, হয়তো এইজন্য এখনো সাঁতার শেখা হয়নি! আফসোস!

 # ছোটবেলায় বিশ্বাস করতাম বাস্তসাপ নামের কোন একটা সাপ সবসময় বাড়ি পাহারা দেয়। কোন চোর-ডাকাত এলে ঐ সাপ তাদের খেয়ে ফেলে। অথবা ঐ সাপের ভয়ে আমাদের বাসায় কোন চোর-ডাকাত আসেনা। মাঝে মাঝে এইটা-অইটা হারায় গেলে ভাবতাম সাপটা হয়তো গোসল করতে গেছে, এই ফাঁকে চোর এসে নিয়ে গেছে। অনেকদিন বাসার নীচতলায় খোঁজাখুঁজি করতাম সাপটা দেখার আশায়!

# নানুবাসায় গেলে দুপুরে অথবা সন্ধ্যায় খাওয়ার পর দেখতাম আশেপাশের বাচ্চারা ম্যাচবক্স নিয়ে বাইরে আসে। সিগারেট খাওয়ার জন্য না, বদ জ্বীন আছর যেন আছর না করে এইজন্য! আমাদের হাতে ম্যাচ ধরায় দিলে কয়েকটা বাড়ি পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল মাত্রায় ছিলো বলে আমাদেরকে সুপারি খাইয়ে দেয়া হতো। সুপারিও বদ জ্বীনের নজর থেকে দূরে রাখে!

# দাদাবাড়িতে বছরে একবার যেতাম কয়েক সপ্তাহের জন্য, যাওয়ার পর সার্কাসের মতোন অনেকে আমাদের দেখতে আসতো, গ্যাদা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে। বাচ্চার মা'দের হাতে পেরেক অথবা এক খন্ড রড থাকতো। গ্যাদা বাচ্চাদের যেন "খারাপ বাতাস" ক্ষতি না করতে পারে। অনেকে আমার আম্মুকে সাজেশন দিতো বাইরে গেলে যেন আমাদের পকেটে পেরেক দিয়ে দেয়া হয়। অনেকে দাবী করতো তারা যখন পেরেক ছাড়া বাইরে যায় তখন তালগাছের সমান লম্বা ভূত বাচ্চাদের নিতে আসে। এখনো গ্রামে গেলে ছোট বাচ্চাদের বিছানায় পেরেক দেখি।

# কড়াইতে করে কিছু খেলে অথবা কড়াই থেকে সরাসরি কিছু নিয়ে খেলে চেহারা কড়াইয়ের মতো কালো হয়ে যাবে বিশ্বাস করতাম। এই বিশ্বাসে অবশ্য কনফিউশন ছিলো আম্মু'র কারনে। আম্মুতো কতো কিছুই খেত কড়াই থেকে নিয়ে, আম্মু'র চেহারা কড়াইয়ের মতোন কালো তো হয়ই নাই, মনে হতো ফর্সা হতে হতে চেহারা কতোদিন পর অদৃশ্য হয়ে যাবে!

# সুর্যগ্রহনের কাহিনীটা মনে নাই। যতটুকু মনে আছে তা হলো, সুর্য ছিলো মামা আর চাঁদ ভাগ্নে। উল্টাটাও হতে পারে। ভাগ্নে মামা'র কাছে পচাত্তর পয়সা পাওনা ছিলো, মামা শোধ করতে না পারায় ভাগ্নে প্রত্যেক বছর অথবা কয়েক বছর পরপর মামা'র শরীরের পঁচাত্তর ভাগ খেয়ে ফেলে।

# সুর্যগ্রহন সম্পর্কে হিন্দু ধর্মের মিথঃ
দেবতারা এক সময় সমুদ্র মন্থন করল। এতে অমৃত আর গরল উঠে এল। এই অমৃত যে পান করবে সেই অমর হবে। এটা দেবতাদের আমর করার জন্যই করা হয়েছিল। যেহেতু গরল আছে দেবতারা পান করবে কি ভাবে? ডাক পরল শিবের। তিনি গরল কন্ঠে ধারণ করলেন। তখন থেকে তার নাম হল নীলকন্ঠ। এদিকে এই অমৃত পান করার জন্য অসুরেরাও চেষ্টা করল। এর মধ্যেই রাহু ও কেতু নামে দুই অসুর ছদ্মবেশে অমৃত পান করতে এল। তাদের কেউ না চিনলেও সূর্যদেব ঠিকই চিনে ফেলল। ইতিমধ্যে তারা অমৃত কেবল মুখে দিয়েছে। খবর পেয়ে বিষ্ণু তা চক্র দিয়ে রাহু ও কেতুর গালা কেটে ফেলল। কিন্তু অমৃত তাদের মুখ পর্যন্ত যাওয়ায় তাদে গলা পর্যন্ত অমর হল। এর পর রাহু রাগ করে সূর্যকে গিলে ফেলল। এটাই সূর্যগ্রহণ। গিলে ফেললে গ্রহণ শুরু হয় আর গলাদিয়ে বের হবার মধ্যদিয়ে তা শেষ হয়।

# অনেকে বিশ্বাস করে স্বপ্নে কারো দাঁত পরে যাওয়া দেখলে ধরে নিতে হবে তার কাছের কেউ মারা গেছে। এইটা শুধু বাংলাদেশীরাই না, জাপান-চীন'র মানুষও বিশ্বাস করে। রাতে যদি কখনো কুকুর ডাকে তাহলে বাংলাদেশে ধারনা করা হয় চোর এসেছে। আর চীনে ধরে নেয়া হয় কেউ মারা গেছে।

# অনেকে বিশ্বাস করে কোথাও যাওয়ার আগে ঝাড়ু দেখলে পথে কোন বিপদ হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনেকে ঘর ঝাড়ু দেয়। তারা বিশ্বাস করে ঘুম থেকে উঠে ঝাড়ু না দিলে দুনিয়ার সব বিপদ বাসায় চলে আসবে। আমার আম্মুও দেয়। আম্মু ক্যানো দেয় তা জানিনা।

 # ছোটবেলায় বিশ্বাস করতাম জোড়া কলা খেলে জোড়া বাচ্চাকাচ্চা হবে। কখনো জোড়া কলা খাইনি, জোড়া বাচ্চা হবে এইটা ভেবে না। দেখতে ক্যামন ক্যামন লাগে।

# পড়াশুনা করার পর বই খোলা রেখে উঠে গেলে ঐ বই শয়তান পড়ে বিশ্বাস করতাম। শয়তান বই ক্যানো পড়বে অথবা বই পড়লে কি হবে সেইটা কেউ বলেনি। না জেনেই সবসময় পড়া শেষে বই বন্ধ করে রাখতাম, অথবা উলটা করে রাখতাম য্যানো শয়তাম না পড়তে পারে।

 # এখনো কোন কোন কুসংস্কার বিশ্বাস করতে ভালো লাগে। এরকম একটা হচ্ছে নুডুলস নিয়ে চায়নিজ কুসংস্কার। চায়নিজরা কখনো নুডুলস ভেঙ্গে রান্না করেনা, তারা বিশ্বাস করে আস্ত নুডূলস আয়ু বৃদ্ধি করে, আর ভাংলে আয়ু কমে যায়। এইজন্য স্টিক দিয়ে পেঁচিয়ে খায় কিনা জানিনা। নানু বলতো জন্মবারে চুল কাটালে আয়ু কমে যায়। আম্মু এইজন্য আমাকে বুধবারে চুল কাটাতে দিতো না। চুল কাটানো মহা বিরক্তিকর ব্যাপার, এইটা আমার ভালোই লাগতো। চাইতাম আম্মু য্যানো বুধবারেই আমার চুলের দিকে নজর দেয়!

# এটা কুসংস্কার কিনা জানিনা। বাচ্চাকালে বিশ্বাস করতাম সাপের পা দেখলে "সাত রাজার ধন" পাওয়া যাবে। সাত রাজার কী ধন থাকতে পারে অথবা কিভাবেই বা পাবো তা তো জানতাম না। বাসার পিছনের পুকুরে কোন ঢোঁড়া সাপ দেখলে পা দেখার চেষ্টা করতাম। মাঝে মাঝে ভাবতাম সাপটাকে মেরে পা দেখি, একটু পরই চিন্তা করতাম মরা সাপের পা দেখলে কিছুই পাওয়া যাবেনা!