হুমায়ুন আহমেদ, পঁচাত্তর ও আমার প্যাচাল

হুমায়ুন আহমেদ, পঁচাত্তর ও আমার প্যাচাল
কাফি রশিদ, ১১/৫/২০১২

প্রিয় হুমায়ুন আহমেদ,
আপনি বাংলাদেশের পাঠকনন্দিত একজন প্রথম সারির লেখক। আপনি অনেক অনেক বই লিখেছেন পাঠকদের জন্য। পাঠকদের মন রক্ষার্থে হাসপাতালের বেডে শুয়েও লিখে যাচ্ছেন নতুন নতুন বই। আপনি হয়তো অনেকের গল্পের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করে দিয়েছেন, যারা কখনো গল্পের বই ক্যানো, প্রাতিষ্ঠানিক বইও ছুঁয়ে দেখেনি। আপনিই তো লিখেছিলেন নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, মধ্যাহ্ন, আগুনের পরশমণি, গৌরীপুর জাংশন এর মতোন উপন্যাস। রচনা করেছেন এইসব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার এর মতোন টিভি নাটক।
বাংলাদেশে আপনার সময়ে জনপ্রিয়তায় আপনার আশেপাশে কোন লেখক যেতে পারেননি। আপনার রচিত নাটকের সামান্য এক চরিত্রের জন্য মানুষ মিছিল করতে পারে, আপনার চামড়া তুলে নেয়ার হুমকিও দিতে পারে। আমার চেয়ে বয়সে বড় গুণীজনেরা বলে থাকেন আপনি শিখিয়েছেন কিভাবে “রাজাকার” বলতে হয়। মিসির আলী নামের সাইকিয়াট্রিস্ট তো আপনারই সৃষ্টি। আপনার রয়েছে বিশাল এক পাঠকশ্রেণী, যারা আপনার বই পড়ে হাসার সাথে সাথে কাঁদতেও পারে, চোখ মুছে আবার বই নিয়ে বসে। অনেকে দাবী করেছেন বাংলাদেশের প্রথম সায়েন্স-ফিকশন আপনারই লিখা। আপনার লিখা সায়েন্স-ফিকশন নিয়েও কোন অভিযোগ নেই। দাবী সত্যি হলে আপনার কাছে দেশের সব সায়েন্স ফিকশন পাঠকেরা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। ভৌতিক গল্পও তো কম লিখেন নি। উইজা বোর্ড, ব্ল্যাক আর্ট সম্পর্কে আপনার বই থেকেই অনেকে জেনেছে, রাত-বিরাতে “ভুত” আনার জন্য শ্মশানে যেতেও অনুপ্রাণিত হয়েছে। আপনার বই যেই প্রকাশনী থেকে বের হয়, অমর একুশে বইমেলায় সেই প্রকাশনীর স্টলে যাওয়া যে হিমালয় পাড়ি দেয়ার মতোন কষ্টসাধ্য। আপনিইতো সেই লেখক যিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরষ্কার, শিশু একাডেমী পুরষ্কার, একুশে পদক, জাতীয় চলচিত্র পুরষ্কার, বাকশাস পুরষ্কার, জয়নুল আবেদিন স্বর্নপদক সহ কতো কতো সম্মাননা।

আমি বিশ্বাস করি আপনার মেধা সম্পর্কে কারো কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। কি পারেন না আপনি? মগজ ধোলাই নামে যে একটা বিষয় আছে আপনি তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেরেছেন। এই ক্ষমতা আপনি কি পরবর্তীতে ভালো কাজে লাগাতে লাগাতে পেরেছেন? আমার তো মনে হয় না। আপনার জন্য আপনার ভক্তদের জন্য বিশাল এক সফট কর্নার তৈরি হয়েছে। আপনি এর সুযোগ পুরোটাই নিয়েছেন। গিলিয়েছেন হিমু সিরিজের মতোন নিম্ন মানের বই। প্রথম দিকে ভালো লিখলেও পরবর্তীতে নিম্ন মানের সব বই লিখেছেন।

যাই হোক, একজন লেখক সব ধরনের বই-ই লিখবেন ধরে নিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম আপনি আবারো শঙ্খনীল কারাগার অথবা নন্দিত নরকে’র মতোন বই লিখবেন, যেগুলা আপনি দীর্ঘ লেখক জীবনের প্রথম দিকে লিখেছিলেন।

হতাশ হতে হয় যখন আপনি “গল্প” ছেড়ে পিউর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে বই লিখেন। মুক্তিযুদ্ধের পটভুমির উপর লিখেছেন “জ্যোৎস্না ও জননীর” গল্প নামের বিশাল এক উপন্যাস। বিশ্বাস করবেন না, এইরকম “বাজে” বই আমি এখনো পড়িনি। “বাজে” বলছি এই কারনে যে আপনি বইটিতে অনেক মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। আপনি বলেছিলেন নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন এই উপন্যাসটি। হাহ! এই আপনার নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ? আপনি হয়তো “নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ” বলতে বুঝিয়েছেন স্বাধীনতাপন্থী দের সাথে সাথে স্বাধীনতা বিরোধীদের কথা। স্বাধীনতাবিরোধীরা আজ যেসব মিথ্যাচার ছড়ায় আপনি তার কয়েকটা বিষয় তুলে এনেছেন আপনার উপন্যাসটিতে, আপনি সেগুলা খন্ডন করেন নি, সেগুলো সত্য ধরে কলম চালিয়ে গিয়েছেন। সামান্য টিভি চরিত্রের জন্য যারা মিছিল করতে পারে, তারা কি “জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প” পড়ে সেইসব মিথ্যাচার বিশ্বাস করে বসবে না? মুক্তিযুদ্ধের উপর লিখা আপনার এই উপন্যাসটি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম। বিশ্বাস করুন আমাকে প্রচন্ড হতাশ হতে হয়েছে। আগে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস না পড়লে তো বিশ্বাস করে বসতাম দীর্ঘ নয় মাসে মুক্তিযোদ্ধারা “সেভাবে” কিছুই করতে পারেননি। আপনার উপন্যাসটিতে ব্যক্তিগত বিষয় যেভাবে প্রাধান্য পেয়েছে, “মুক্তিযুদ্ধ” সেভাবে প্রাধান্য পায়নি। মুক্তিযুদ্ধ’র বদলে সেটি ব্যক্তিগতদ্বন্দ্ব/যুদ্ধ বললেই ভালো মানায়।

যাই হোক। দীর্ঘদিন বিদেশে চিকিৎসাধীন শেষে আপনি কিছুদিনের জন্য দেশে এসেছেন। এসেই সবাইকে জানিয়েছেন উনিশশ পঁচাত্তর নিয়ে আপনি একটি নতুন বই লিখবেন। মাফ করবেন, আপনাকে এখন আর আমাকে বিশ্বাস হয় না। আপনার “মেধা” সম্পর্কে আমি আর পজিটিভ থাকতে পারছি না। আমার ধারনা হয়েছে আপনার বইটি পড়ে পঁচাত্তরের ঘাতকেরা বেশ খুশিই হবে। আপনাকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই, আপনি অবশ্যই বুঝবেন আমি ক্যানো এই কথাটি বললাম। ইতোমধ্যে অনেকেই কিন্তু আপনার পঁচাত্তর নিয়ে লেখালেখির বিরোধীতা করছে।

আমি জানিনা অন্যরা কি আশা করছে আপনার কাছে। আমি যা আশা করছি তা হলো আপনি এবার একটু বিশ্রাম নিবেন। জোর করে তো আপনার মতোন লেখককে থামানো যাবে না, আপনি যদি লিখতেই চান তাহলে পঁচাত্তরের “গল্প” যেই বইটিতে লিখবেন সেখানে প্লিজ আর কোন মিথ্যাচার করবেন না।

আপনার সুস্থ্যতা কামনা করছি। আশা করি খুব দ্রুত সুস্থ্য হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন।